ফাষ্ট টাইম টু আমেরিকা


দোহা থেকে জেএফকে’র উদ্দেশ্যে আমাদের ফ্লাইটটি যথাসময়েই ছাড়ল।
 
আমার ধারণা ছিল ফ্লাইটটি সম্পূর্ণ পশ্চিম দিকে রওয়ানা দিবে।
কিন্তু তা না করে প্রথমে উত্তর দিক ধরে ইরানের উপর দিয়ে, তারপর উত্তর-পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করল- আমি এটার কোন হিসাব মেলাতে পারলাম না- যে ঠিক কি কারণে সোজা পশ্চিমে গেল না! তুরষ্ক, ইটালী, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড পার হয়ে আটলানটিকের উপর দেয়ে প্রায় তের ঘন্টা পার করে কানাডার পূর্ব সীমান্ত দিয়ে আবার দক্ষিণে নেমে নিউ ইয়র্ক এর জেএফকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দিকে নামতে শুরু করল; মনিটরে ঘোষণা পেলাম ‘ওয়েল কাম টু দা ইউনাইটেড ষ্টেটস্’।
 
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তারপরও ভূগোল এবং বিশ্বরাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি আমার একটু বেশীই ঝোঁক সেই ছোটবেলা থেকেই- যখন আমি মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র এবং টুকটাক বুঝতে শুরু করেছি এই বিশাল পৃথিবীটাকে। বিশ্ব তখন দুই দিকে বিভক্ত- এক দিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন কাম রাশিয়া আর অপরদিকে পুঁজিবাদী আমেরিকা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
 
সেই ছোট বেলা থেকেই আমি আমার অতি-অল্প জ্ঞান নিয়েই এবং কোন কারণ ছাড়াই সব বিষয়েই আমেরিকার পক্ষে। আর নব্বই এর দশকের প্রথম দিকেই আমার মাথায় একটা পোকা ঢুকল যে, ‘আমি আমেরিকা যাব’।
 
স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়া অনেক কষ্ট- টোফেল এ খুব ভাল স্কোর দরকার হয়; অনেক টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স দেখাতে হয়; আমার আবার নিয়মের মধ্যে পরে থাকতে কোনকালেই ভাল লাগে না! গঁদবাধা সবকিছুই আমার কাছে চরম বিরক্তিকর! নিয়মের বাইরে গিয়ে চলাই আমার পছন্দ।
 
আমি চিন্তা করলাম সবচে ভাল হয় টুরিষ্ট ভিসা।
আর তাছাড়া আমি তো একজন ভাল টুরিষ্ট-ই। ব্যবসায় শুরু করার ২ বছরের মধ্যেই আমি বাংলাদেশের ৪৬০টি উপজেলার মধ্যে আমি প্রায় ৪৩০টি উপজেলা বা থানা পর্যায় পর্যন্ত একজন পাক্কা টুরিষ্ট হিসাবে ঘুরে ফেলেছি।
 
চটজলদি একটা পাসপোর্ট করে ফেললাম।
ইন্ডিয়ার ভিসা নিয়ে কলকাতা হয়ে শিলিগুড়ি চলে গেলাম। বাংলাদেশের পার্সপোর্টে ইন্ডিয়া ডাবল এন্ট্রি ভিসা দেয় না, তাছাড়া তখন আমি ওসব বুঝিও না! কাজেই নেপাল ভ্রমণে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সিকিম তো বাংলাদেশ আর পাকিস্তানীদের জন্য নিষিদ্ধ রাজ্য। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে কি কাউকে থামিয়ে রাখা যায়?
 
পাসপোর্টটি লুকিয়ে রেখে আমি ‘ইন্ডিয়ান’ পরিচয় দিয়ে চলে গেলাম সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক, বেড়ালাম দার্জিলিং এবং সেখান থেকে মিরিক হয়ে পশুপতি বর্ডার দিয়ে ঢুকে গেলাম নেপালে। কেউ জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন বোধ করল না আমি কোন দেশের মানুষ! সেখান থেকে ১৭ ঘন্টার বাস জার্নি করে একেবারে কাঠমান্ডু। আমার ঐসময়ে সবচে প্রিয় শহর কাঠমান্ডু ভ্রমণ শেষ করে নেপাল-ভারতের সোনেওয়ালী বর্ডার দিয়ে গোরাকপুর হয়ে ফিরলাম আবার কোলকাতায়; তখন আমার বয়স ২২ কি ২৩।
 
দেশে ফিরে মায়ানমারের ভিসা লাগালাম আমার পাসপোর্টে- কিন্তু সড়ক পথে বাংলাদেশ থেকে মায়ানমার যাবার কোন ইমিগ্রেশন ও চেকপোস্ট নেই; যাওয়া হল না। বিমানে চড়ার মতো অত টাকা তখন আমার কোথায়? অবশ্য তাই বলে বিমানে চড়া বাদ রাখিনি। চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানের এটিপি এয়াক্রাফটে করে ঠিকই ঘুরে এসে বিমান ভ্রমনের শখও মিটিয়েছি মাত্র ৩৩০টাকায় টিকেট কেটে- সেই ১৯৯৪ সালেই।
 
সালটা তখন ১৯৯৬।
কোন এক সকালে বারিধারার আমেরিকার এম্বাসীতে আমিও শতশত মানুষের সংগে ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম।
 
১৯৯৭ সালে আবারও।
বুঝে ফেললাম হবে না। আমেরিকার আশা বাদ।
 
ততদিনে নিজের ব্যবসায়ও মনযোগ দিয়েছি খুব ভালভাবেই।
সিদ্ধান্ত নিলাম আমেরিকা যাব না। দেশেই ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হব। আর আমার ভ্রমণ নেশাতো আছেই- কাজেই এমন ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করব যাতে ভ্রমণের উপরেই থাকতে পারি।
 
যা ভাবা তাই করা- শুরু হল আমার ব্যবসায়ী জীবন; বাংলাদেশে ব্যবসায় মানেই হলো ব্যস্ততা আর টেনশন; দুটোই আমার ছিল। তারপরও এগিয়েই যাচ্ছিলাম। ঢাকা চেম্বারের পাশাপাশি, ব্যবসায়ীদের র্শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর জেনারেল বডিতে স্থান করে নিয়েছি- তাও অনেক আগেই।
 
কিন্তু নিজেকে যতই আড়াল করি না কেন- আমেরিকার ভূত মাথা থেকে কখনওই নামাতে পারিনি। ইচ্ছা এবং ইচ্ছার সাথে পরিশ্রম ও একাগ্রতা থাকলে সবই পাওয়া যায়- এটা আমি বিশ্বাস করি।
 
গত ১৭ বছরে সত্যিই আমি প্রচুর ভ্রমণ করেছি; প্রচুর। ১৯৯৬ সালে আমি প্রথম ভারত ভ্রমণ করি। কলকাতায়- তারও প্রায় ১২ বছর আগে সাবওয়ে মেট্রো রেল চালু হয়েছে। আমি অভিভুত হলাম- মাটির নীচ দিয়ে রেল লাইন; দারুণ।
 
কিন্তু পুরো ভারতবর্ষটাই অত্যন্ত অপরিচচ্ছন্ন দেশ।
ভারতীয়রা প্রস্রাব পায়খানার জন্য বাথরুমের চেয়ে উম্মুক্ত রাস্তাঘাটকেই বেশী পছন্দ করে। আগরতলা, গৌহাটি, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, কলকাতা, গ্যাংটক, পাটনা, লক্ষ্নৌ, আগ্রা, দিল্লী, উদয়পুর, মুম্বাই, পুনে কোথাও আমি এর ব্যতিক্রম দেখিনি। নতুন দিল্লী রিসেন্টলি একটু চেঞ্জ হচ্ছে। মুম্বাই এখনও নোংরা একটি শহর।
 
চায়না দেশটাকে দেখে আমি সত্যিই অভিভূত।
অসম্ভব সুন্দর একটা দেশ। মানুষগুলো আরও ভদ্র। ঝকঝকে তকতকে পরিচ্ছন্ন পরিপাটি রাস্তাঘাট, সুউচ্চ ভবনসমূহ, সুপার-ক্লিন বাথরুম, সবকিছু। বেইজিং, সাংহাই, গুয়াজু, সেনজিন, কুনমিং, চেঞ্জদু, চিনতাও কোন শহরই কোনটার চেয়ে কম সুন্দর নয়। বেইজিং, সাংহাই, সেনজিন এর পাতালরেল বা সাবওয়ে আরও বেশী সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। ৪৯৭কিলোমিটার স্পীডে আমি হংজু থেকে সাংহাই আসলাম বুলেট ট্রেনে উঠার অভিজ্ঞতা নিয়ে। এই দেশটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি- সত্যিই। বিশ্বের সেকেন্ড নিউ ইয়র্ক খ্যাত সাংহাই আমার সবচে পছন্দের শহর।
 
হংকং আরও সুন্দর- ছবির মতো সাজানো একটা দেশ।
সাবওয়ে সিষ্টেম আরও মডার্ন, ওখানে সাবওয়েতেও একমুহূর্তের জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয় না। আর সারগর ঘেষা হংকং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ ল্যান্ড করার সময় মনে হয় যেন বেহেস্তে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি।
 
মালয়েশিয়ার কুয়ালা লামপুর শহরটি মূলতঃ গড়ে উঠেছে বছর ত্রিশেক হলো। শহরটিতে পা রাখলেই বোঝা যায় একটি আনকোরা নতুন ঝকঝকে শহর, আরও ঝকঝকে এর স্কাইট্রেন, মনোরেল, কেটিএম ও এলআরটি সিষ্টেম; বাস সার্ভিসও দারুন। শহরটিতে রয়েছে কিছু ফ্রি বাস সার্ভিস- যার আবার অধিকাংশ যাত্রীই বাংলাদেশী।
 
চায়না, হংকং, সিংগাপুর, মালয়েশিয়ার ঝকঝকে রাস্তাঘাট, সাবওয়ে আর সুউচ্চভবনগুলো দেখে দেখে আমার চোখ অভ্যস্ত- বিদেশ বলতেই আমি চোখ বন্ধ করে সবসময় অনুভব করি ঝকঝকে তকতকে, পরিচ্ছন্ন, নয়নাভিরাম আর শৃঙ্খলা-সম্পন্ন শহর। সাংহাই শহরে আমি ৪০ তলার নিচে কোন ভবন দেখিনি বলতে গেলেই- এক আধটু ব্যাতিক্রম ছাড়া। ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ব্রীজ পার হয়েছে ওয়েজু থেকে শ্লীপিং বাসে করে সাংহাই যাবার পথে; ওটাই সম্ভবত বিশ্বের সবচে দীর্ঘতম ব্রীজ।
 
সেই হিসাবে আমার স্বপ্নের আমেরিকা তো আরও বেশী সুন্দর হবার কথা।
আমার প্রয়াত বড় কাকা নব্বই এর দশকে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে সবাই-কে প্রথম যে কথাটা বলতেন তা হলো- ‘কি যে সুন্দর দেশ!’। সে-হিসাবে আমার মাথায় ঢুকে ছিল আমেরিকা না যেন কত ঝকঝকে তকতকে সুন্দর একটা দেশ- কত কিছু দেখব, কত অভিভূত হব ইত্যাদি। আমি আরও আরও বেশী অভিভূত হবার জন্য সত্যিই খুব অপেক্ষায় ছিলাম দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় ধরে। অপর দিকে আমি আমেরিকা রওয়ানা দেবার মাত্র দুই দিন আগে চায়না আমেরিকাকে পেছনে ফেলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়ে গেল- যা আরও পাঁচ-সাত বছর আগে থেকেই আলোচনায় ছিল, অবশ্য ১৩০ কোটি মানুষের দেশের অর্থনীতি মাত্র ৩০ কোটি দেশের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাওয়া তো আরো আগেই উচিত ছিল।
 
আমাদের বহনকারী বিমানটি যখন জেএফকের দিকে অবতরণের জন্য খুব নীচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল- নিউ ইয়র্কের রাস্তা-ঘাট, গাড়ী আর ভবনগুলো দেখা যাচ্ছিল- আমি অতি আগ্রহ নিয়ে জানালা দিয়ে নীচের দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবলাম- জেএফকে এয়ারপোর্টটি সম্ভবত ডাওনটাউন এ তাই এলাকাতে গ্রাম গ্রাম আর ফাঁকা ফাঁকা একটা ভাব- কিন্তু অত সুন্দর কৈ?
 
কাতার এয়ারওয়েজ এর বিমানটি ল্যান্ড করার পর অনেকটা সময় নিল নির্ধারিত ৮ নম্বর টার্মিনাল ভবনে পার্ক করতে।
 
বিশাল এলাকা নিয়ে জেএফকে এয়ারপোর্ট এর ট্যাক্সিওয়ে। আমি যদিও কুয়ালা লামপুরের কেএলআইএ এবং কেএলআইএ-২ এই দু’টো এয়ারপোর্টই দেখেছি অনেক অনেক বার, বেইজিং এর বিশাল এয়ারপোর্টটিও আমার মুখস্ত; কাজেই জেএফকে-কে আমার কাছে একটু অগোছালে এবং ছোট-ই মনে হলো আমার আশার চেয়ে।
 
জাহাজ থেকে নেমে বের হয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে যাবো।
কেএলআইএ, চাংগি সিংগাপুর, বেইজিং, সাংহাই, ব্যাংকক সূবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট ইত্যাদি এয়ারপোর্টগুলোর চেয়েও জেএফকে অনেক অনেক বড় আর গোছানো হবে- এটাই ছিল আমর বদ্ধমূল ধারণা। ধারণায় হোঁচট খেলাম। মনে হলো একটি বদ্ধ এবং ছোট টানেল পার হয়েই পৌছে গেলাম ইমিগ্রেশনের সামনে; এখানে চাকচিক্য একেবারেই অনুপস্থিত। আবারও হতাশ হলাম! এইটা কোন এয়ারপোর্ট হলো? কিচ্ছু নাই, সত্যিই কোন কিছু নেই দেখার মতো।
 
ইমিগ্রেশন পার হয়ে কাষ্টমস থেকে লাগেজগুলো সংগ্রহ করবো।
বেল্টে আমাদের বহনকারী ফ্লাইটের কোন নাম খুঁজে পেলাম না। একটা বেল্টেই সব লাগেজ ঘুরছে। তার আগে আমার লাগেজগুলো বহনের জন্য একটা ট্রলি দরকার। আমার পেছনেই দেখলাম কিছু ট্রলি সাজানো। নিতে গেলাম- পারলাম না, টানাটানি করেও বের করতে পারলাম না ট্রলিটি। সিকিউরিটির একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘ট্রলির জন্য তোমাকে পে করতে হবে’; সে আমাকে একটা মেশিন দেখিয়ে দিল। আমি এগুলাম- ৬ ডলার ভাড়া। আমি ক্যাশ পেমেন্ট করলাম মেশিনের মধ্যে, একটা ছোট আওয়াজ শুনলাম- ট্রলিতে হাত দিতেই ওটা আমার হাতে চলে আসলো।
 
আমেরিকায় আমার খরচ শুরু হয়ে গেল।
বুঝলাম ’কি’ দেশে এসেছি! ট্রলির জন্যও ভাড়া দিতে হয় এখানে। বিশ্বের কোন এয়ারপোর্টে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি ট্রলির জন্য কোন ভাড়া প্রদান করতে হয়; এত এত টাকা এয়ারপোর্ট ট্যাক্স দিয়ে টিকেট কাটি আর সামান্য ট্রলির জন্য ৬ ডলার!
 
কুয়ালা লামপুর কেএলআইএ বা কেএলআইএ-২, চাংগি সিংগাপুর, বেইজিং, সাংহাই বা সম্প্রতি রিনোভেটেড দিল্লী ইন্দিরা গান্ধি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট অথবা নবনির্মিত কোলকাতা নেতাজী সুভাষ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টগুলোর ধারে-কাছেও নয় সৌন্দর্যের দিক দিয়ে জেএফকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটি। বিমান উঠানামা, যাত্রী ইমিগ্রেশন ও কাষ্টমস এর কার্যক্রম ছাড়া উল্লেখ করার মতো আর কোন কিছু নেই জেএফকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটিতে।
 
চায়নার কুনমিং সিটি এবং কুনমিং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট সম্পর্কে কিছু কথা না বলে পারছি না।
আমি প্রথমবার কুনমিং তথা চায়না যাই ২০০৫সালে যেদিন কুনমিং-ঢাকা-কুনমিং রুটের সরাসরি বিমান যোগাযোগের উদ্ভোধন হলো চায়না ইষ্টার্ণ এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে। সফরটি ছিল বাংলাদেশ-চায়না (সিনো-বাংলা) কুটনৈতিক সম্পর্কের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অল চায়না ইয়ূথ ফেডারেশন (চায়নার যুব মন্ত্রণালয়ের অধীন) এর আমন্ত্রণে একটি সরকারী সফরের অংশ। ঐ শহরের নামও আমি আগে শুনিনি। ম্যাপ মেপে দেখলাম ঢাকা থেকে মাত্র ১৪০০ কিলোমিটার দুরে কুনমিং, ঢাকা থেকে দিল্লীর চেয়েও কাছে। ২ ঘন্টার ফ্লাইটে পৌছে গেলাম কুনমিং। ‘সিটি অব ফ্লাউয়ার’ নামে খ্যাত কুনমিং দেখে আমি সত্যিই অভিভূত। চির বসন্তের শহর কুনমিং- ইউনান প্রভিন্সের রাজধানী। ইউনানী ওষুধের নাম আমরা ছোটবেলায় শুনেছি। ইউনান থেকে ঐসব ওষুধগুলো মিয়ানমার দিয়ে বাংলাদেশে আসত। কুনমিং এর রাস্তাঘাটগুলো ফুলে ফুলে ভরা।
 
এয়ারপোর্টটিও চমৎকার সুন্দর ও বিশাল।
কুনমিং এর ’স্টোন ফরেস্ট’ যে একবার না দেখেছে- সে পৃথিবীর কিছুই দেখেনি! ন্যাচারালি স্টোনেরও যে জঙ্গল হতে পারে সেটা ভাবাই যায় না!
 
তো এই কুনমিং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট দিয়ে আমি অনেক অনেক বার যাতায়াত করেছি এবং এয়ারপোর্টটি আমার খুবই পরিচিত হয়ে গেছে। ২০১২ সালের প্রথম দিকে একবার আমি সেনজেন থেকে কুনমিং হয়ে ঢাকা ফিরবো। আমাকে কুনমিং এ ১ রাত থাকতে হবে ঢাকার ফ্লাইট ধরার জন্য। যেহেতু কুনমিং শহরটি আমার খুবই চেনা আর আবহাওয়াও দারুণ- তাই ভালই লাগবে।
 
কিন্তু সেদিন- কুনমিং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ জাহাজ থেকে বের হবার পর আমার একটু কেমন যেন খটকা লাগলো! আমি কুনমিং এসেছি তো? নাকি বিমান অন্য কোথাও আমাদের নিয়ে গেলো? সব সাইনবোর্ড দেখলাম- হ্যাঁ! কুনমিং-ই লেখা রয়েছে। কিন্তু এটা তো আমার চিরচেনা সেই কুনমিং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট নয়। বিশাল এয়ারপোর্ট- বিশাল; আরও পরিচ্ছন্ন, আরও ঝকঝকে তকতকে, সাজানো-গোছানো। অনেকটা সময় লাগলো একের পর এক টার্মিনালগুলো চলমান পথ ও পাঁয়ে হেটে অতিক্রম করে লাগেজের বেল্ট পর্যন্ত আসতে। এয়ারপোর্টের বাইরে বের হয়ে দেখলাম এটা তো একটা বিশাল গ্রাম! তাহলে কোথায় গেল আগের সেই এয়ারপোর্ট। আমি তো মাত্র ৪ দিন আগেও কুনমিং এসেছিলাম যদিও থাকিনি- এটা তো সেই এয়ারপোর্ট নয় যেটা আমার অনেক বছরের চেনা! তাহলে?
 
চায়নিজরা ইংলিশ জানে না।
অনেক কষ্টে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আজই এই এয়ারপোর্টটি উদ্বোধন করা হয়েছে। আগের এয়ারপোর্ট ছোট ও শহরের ভেতরে, তাই আর একটি নতুন এয়ারপোর্ট! আর আগেরটি পরিত্যক্ত; ওটা নাকি আজই ভেঙ্গে ফেলা শুরু হয়ে গেছে।
 
আগে থেকেই অনলাইনে আমি ম্যানহাটনের হারলেম এলাকায় একটি বড় রুম এক সপ্তাতের জন্য ভাড়া করে রেখেছিলাম। অনলাইনে দেখেছি নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত ইয়োলো-ক্যাবে যেতে আমার ভাড়া লাগবে ৫৫ ডলারের মতো।
 
ট্যাক্সি আমাকে নিয়ে চলতে শুরু করল, ট্যাক্সিতে এসি অফ ছিল।
হালকা গরম লাগছিল। নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাট আর বাড়ীগুলো দেখতে লাগলাম। নাম না জানা খুবই সুন্দর একটি লেক দেখতে দেখতে আরও সামনে এগিয়ে লা-গুরদিয়া এয়ারপোর্ট ডানে রেখে হারলেমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্যাক্সি। রাস্তাঘাট অনেকস্থানেই নোংরা, ব্যবহৃত জিনিস-পত্র রাস্তার সাথে ফুটপাতে পড়ে আছে। বাড়ীগুলো সব প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো- একই রকম দেখতে; বৈচিত্র্য লক্ষ করলাম না কোন কিছুতেই। আমি সত্যিই হতাশ হলাম নিউ ইয়র্ক সিটি দেখে। ট্যাক্সি আমাকে ড্রপ দিল- ৬০ ডলার দিয়ে দিলাম; ড্রাইভার থ্যাংক য়্যু বলে চলে গেল।
 
সবার আগে একটা সীম (নতুন মোবাইল কানেকশন) কেনা দরকার।
জেএফকে থেকে ২০ ডলার দিয়ে মেশিন থেকে একটা সীম কিনেছিলাম- ১০ ডলার ব্যালেন্স ছিল। সর্বমোট ৪/৫টা অল্প মিনিটের কয়েকটা লোকাল কল আর একটি আমার বাবা-মাকে ঠিকমত পৌঁছেছি জানাতে ১ মিনিটের একটি ওভারসীজ কল করেছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। কোন কল আসছেও না।
 
ব্লাক আমেরিকান অধ্যূষিত হারলেম আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন একটা এলাকা।
অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা মোবাইলের শো-রুম পেলাম; কিন্তু ওরা ’শুধু কানেকশন‘ বিক্রি করবে না। অনেক রিকোয়েষ্ট করার পর- আমাকে এটিএন্ডটি এর গো-মোবাইল প্যাকেজের নতুন কানেকশন একটিভেট করে দিল। ৭০ ডলার মান্থলি প্যাকেজ- সারা আমেরিকায় আনলিমিটেড কল করা যাবে; টেক্সট ফ্রি, ইন্টারনেট ফ্রি। আরও ৫ ডলার চার্জ করে ইন্টারন্যাশনাল টেক্সট এর প্যাকেজ নিলাম; কিছুই বুঝতে পারলাম না ঠিক কি কি নিলাম! শুধুমাত্র আমেরিকায় কল করা যাচ্ছে, ইন্টারনেট পাচ্ছি আর লোকাল এসএমএস করতে পারছি। যা ই হোক সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই নাম্বারটি ঠিক রেখে আমার মোবাইল প্লান চেঞ্জ করে নিলাম। এখন আমাকে মান্থলী গুনতে হবে ২৯ ডলার আর সেবা’টির নাম লাইকা মোবাইল।
 
আমি জানি আমেরিকায় টেপের পানি সরাসরি খাওয়া যায়।
তারপরও দোকানে যেয়ে ২ লিটারের একটি পানির বোতল কিনলাম ৪ ডলার দিয়ে। আমেরিকা কি জিনিস প্রথম দিনেই বুঝে ফেললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম বাজার করে রান্না করে খাব। নীচ তলায় আমাদের জন্য ওয়েল ইকুইপ্ট কিচেন ছিল- রান্নার আয়োজন শুরু করে দিলাম। রান্না করে খাওয়া দাওয়া শুরু করলাম।
 
ইন্টারনেট দেখলাম আমি যেখানে আছি সেখান থেকে সাবওয়েতে ট্রেনে করে ফরটি-সেকেন্ড ষ্ট্রিটে নামতে হবে টাইমস স্কোয়ার যেতে হলে।
পরিচিত দু’একজনকে ফোনে জিজ্ঞেস করে সহজ কোন ইনফরমেশন পেলাম না সাবওয়েতে যাতায়াতের গাইডলাইন হিসাবে। হারলেমে আমার বাসার খুব কাছে হানডেন্ট টুয়েন্টি ফাইভ ষ্টেশন থেকে সাবওয়েতে ফরটি সেকেন্ড ষ্ট্রিট যাবার জন্য টিকেট কাটতে গেলাম; অসংখ্য ট্রেনের নাম এবং রুট ও ভাড়া সম্পর্কে কিছুই জানি না। ২.৭৫ ডলারে সিংগেল রাইড। অর্থাৎ যে-কেউ ২.৭৫ ডলারে একটি টিকেট কেটে নিউ ইয়র্কের সাবওয়েতে যেখানে খুশি যেতে পারবেন এমনকি এই একই টিকেটে ২ ঘন্টার মধ্যে যে-কোন সিটি বাসেও উঠা যাবে। নিউ ইয়র্কের মাটির নীচ দিয়ে বটগাছের শাখা-প্রশাখার মতো রেল লাইন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা সাবওয়ের ভেতরে ঢুকলাম। যথেষ্ঠ নোংরা এবং অসুন্দর প্লাটফর্ম; পছন্দ হবার মতো কোন কিছু পেলাম না। ইভেন কোলকাতা সাবওয়ে মেট্রোও এতটা নোংরা নয়।
 
কোলকাতা মেট্রো, কুয়ালা লামপুর এর এলআরটি বা স্কাইট্রেন কাম সাবওয়েতে যাতায়াত করেছি অসংখ্যবার- কি ঝকঝকে তকতকে প্লাটফর্ম, টিকেটিং সিষ্টেম; কাজেই আমি বিরক্ত। আমার পকেটে ‘টাচ এন্ড গো’র একটি টিকেট এখনও রয়েছে- যেটা দিয়ে আমি কুয়ালা লামপুর শহরে ট্রেনে খুব সুন্দরভাবে এবং অল্পখরচে যাতায়াত করতাম; কার্ডটি গেটে টাচ করলেই গেট ওপেন হতো আর বেরুবার সময় আবার টাচ করলে আমার বিল কেটে রাখতো, ব্যালেন্স দেখাতো। তবে, এখানে একটা বিষয় আমি ভেবে সত্যিই প্রচন্ড অবাক হয়েছি যে- এই সাবওয়ে ট্রেন লাইনগুলো আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশী আগে তৈরী। আমার মাথা গুলিয়ে গেল।
 
যা-ই হোক, ফরটি সেকেন্ড গ্রাউন্ড সেন্টারে নামলাম।
ম্যানহ্যাটনের সুউচ্চ ভবন আর টিভিতে দেখা নিউ ইয়র্কের বিশাল বিশাল রাস্তা, চলাচলরত ইয়োলো ক্যাব আর প্রাইভেট কারের ভীড়; ম্যানহ্যাটনের নয়নাভিরাম আকাশচুম্বি ভবনগুলো আর রাস্তা দেখে চোখ জুড়ালো কিন্তু মন জুড়ালো না। হাঁটতে হাঁটতে সেন্টার পার্ক পৌঁছলাম। বিশাল ব্যস্ত শহরের ভেতরে এমন নিরব একটা পার্ক- সত্যি অবিশ্বাস্য সুন্দর। বেড়ালাম অাপন মনে অনেকক্ষন।
 
কিন্তু আমি যে আমেরিকার আরও কিছু সুন্দর দেখতে চাই!
আমি ফরটি সেকেন্ড ষ্ট্রিট খুঁজে পেলাম কিন্তু টাইমস স্কোয়ার কোথায়? সত্যি খুঁজে পেলাম না। সাবওয়ে মেট্রো ঠিকঠাক বুঝি না।
বাসায় ফেরার জন্য আবারও সিঙ্গেল রাইড টিকেট কিনলাম কিন্তু কোন ট্রেনে যাব? আন্দাজের উপর উঠে বসলাম এবং ভূল করলাম। মনে মনে ভাবলাম আমি যে কতবড় বোকা সেটা আমি ছাড়া আর কি কেউ জানে?
 
মনে পরলো- আজ থেকে ১০০ বছরেরও আগের ইতিহাস-কাম উপন্যাস ’প্রথম আলো’তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বর্ণনা দিয়েছিলেন ত্রিপুরার রাজা আগরতলা থেকে হাতির পিঠে সাওয়ার হয়ে পূর্ব বঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের আশুগঞ্জ-কুমিল্লা-ঢাকা-খুলনা হয়ে) ঘনজঙ্গলে ভরা অসংখ্য ঝোপ-ঝাড়, নদী-নালা পার হয়ে বৃটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতায় পৌছেছিলেন। ঠিক সেই সময়টায় নিউ ইয়র্কে গড়ে উঠেছে এই সাবওয়ে সিষ্টেম। ১০০ বছরেরও আগে! ভাবা যায়।?
 
নিউ ইয়র্কে বর্তমানে যে কাঠের প্রাইভেট হাউজগুলো দেখা যাচ্ছে এবং এই যে রাস্তাঘাটসমূহ যেখানে যান-জটের কোন অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না- তার ডিজাইনও এক থেকে দেড়শত বছর আগে করা। আমেরিকাতে আজ প্রতি ১০০০ লোকের জন্য রয়েছে ৭৮৬টি কার; যেখানে বাংলাদেশে রয়েছে ৩টি। আমি এখানে নিউ ইয়র্ক এর সাথে ঢাকাকে তুলনা করতে কোন সাহসই পাচ্ছি না।
 
কুয়ালা লামপুর, হংকং, কলকাতা, দিল্লী, সিওল এবং চায়নাতে যে সাবওয়ে ট্রেনগুলো চলাচল করছে তাতে আমি এক সাথে ২/৪টির বেশী কোচ সংযোজিত দিখিনি। কিন্তু নিউ ইয়র্কের বিশাল বিশাল ট্রেনগুলো যাত্রীভর্তি কোচ নিয়ে চলাচল করছে কি সুন্দর, সুশৃঙ্খলভাবে; অবাক লাগছে দেখে ও এর গর্বিত যাত্রী হতে পেরে। দিন কয়েক পর আমি ১১২ ডলার দিয়ে মান্থলী আনলিমিটেড রাইড এর একটি সাবওয়ে এমটিএ মেট্রোকার্ড কিনে নিয়েছি এবং আমি এখন বলতে গেলে বিনা ভাড়ায় নিউ ইয়র্কের যে-কোথাও চলাচল করতে পারছি।
 
নিউ ইয়র্কে আমি মজা পাচ্ছি না।
সাদা মানুষের চেয়ে কালো এবং হিস্পানিক, বাংলাদেশী, ইন্ডিয়ান, গায়ানার লোকদের সংখ্যাই বেশী মনে হচ্ছে। হারলেমে এক সপ্তাহ থাকার পর আমি জামাইকায় ছোট একটি বাসায় এসে উঠলাম। জামাইকা ও জ্যাকসন হাইটস এলাকায় বাংলাদেশী লোকদের বসবাস। দোকানপাঠ প্রায় সবই বাংলাদেশী মালিকানাধিন এবং সব দোকানের সাইনবোর্ডেই বলতে গেলে বাংলা লেখার ছড়াছড়ি।
 
কিন্তু আমার ভাল লাগছে না; বাঙ্গালী দেখার জন্য তো আর আমি আমেরিকায় আসিনি!
নিউ ইয়র্কের কোন টেষ্টও পাচ্ছি না। পত্র পত্রিকায় যা পড়েছি বা মানুষের মুখে আমেরিকা বলতে যা যা শুনেছি তার সাথে কিছুই মেলাতে পারছি না। পুরাতন একটি শহর যদিও বাস, ট্রেন আর গাড়ীগুলো অত্যাধুনিক। ট্যাক্সিতে উঠার মতো ডলার আমার পকেটে নেই বললেই চলে। তারপরও ৩ দিন বাধ্যতামূলকভাবেই ইয়োলো ক্যাবে চড়তে হয়েছে এবং এভারেজে ৫০/ ৬০ বিল দিতে হয়েছে প্রতিবার; আর ওঠা যাবে না।
 
আনলিমিটেড মেট্রোকার্ড থাকাতে আমি নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে ম্যাপটি আমার মোবাইলে ডাওনলোড করে নিয়ে পুরো নিউ ইয়র্ক চষে বেড়াচ্ছি।
কনি আইল্যান্ড এ সী-বিচটি সত্যি দেখার মতো কিন্তু কক্সবাজারের মতো নজরকাড়া নয়। রকওয়ে বীচও ভাল লাগলো, ট্রেনে বসে বিশ্বের সবচে ব্যস্ততম জেএফকে’র বিমানের উঠানামা দেখতে ভালই লাগলো রকওয়ে বীচের যাবার পথে। কিন্তু সত্যিই সেরকম কিছু পাচ্ছিলাম না- যেটা দেখলে আমেরিকাকে আমেরিকাই মনে হবে!
 
একদিন গেলাম স্ট্যাটান আইল্যান্ড-এ।
’স্ট্যাটান আইল্যান্ড শীপ’ এ চড়ে লিবার্টি আইল্যান্ড এর পাশ দিয়ে নিউ ইয়র্কের স্কাইলাইন পেছনে ফেলে উপসাগর দিয়ে এগিয়ে যাবার যাত্রা খুবই চমকপ্রদ- ওসব সৌন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও মনের ক্ষুধা মিটছিল না। নাইন এলেভেন খ্যাত নবনির্মিত ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ঘুরলাম; গ্রাউন্ড জিরো টু’টো দেখলাম- খুব খারাপ লাগলো ধ্বংশ হয়ে যাওয়া টুইন টাওয়ারস দেখতে পারলাম না বলে এবং ধ্বংশ করে ফেলার মতো গর্হিত কাজের জন্য; ভালোও লাগলো নতুন উদ্যোগ নিয়ে আবার গড়ে তোলার জন্য।
 
এখানে কিছু বিষয়ে অভ্যস্থ হয়ে গেছি।
যেমন- মোবাইলের এ্যাপসে কবে কতটুকু ঠান্ডা পড়বে, কবে কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত কতটুকু পরিমাণ বৃষ্টি হবে সবই যেন পূর্ব নির্ধারিত! আবহাওয়া সংবাদ আমেরিকাবাসীর জীবনের অপরিহার্য অংশ। বাংলাদেশের মতো ‘বৃষ্টি হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে’ টাইপের আবহাওয়া সংবাদ দেখতে হয় না।
 
নিউ ইয়র্ক সিটিতে এখনও বরফ বা স্নো পরা শুরু হয়নি।
তাপমাত্র ৩০ থেকে ৪৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট (-৪ থেকে +৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস) এর মধ্যে উঠানামা করছে। কঠিন হাড় কাপানো শীত কিন্তু প্রতিদিন একই রকম নয়- হয়তো এক দুই দিন খুব শীত তারপর আবার দুইএক দিন একটু গরম; একদিন হয়তো শীতের সাথে খুব বেশী ঠান্ডা বাতাস আরেকদিন ঝুম বৃষ্টি। জানলাম- শীত, স্নো, বৃষ্টি কোন কিছুতেই নিউ ইয়র্ক বন্ধ থাকে না। যা খুশি হোক- সারা বছরই নিউ ইয়র্ক সচল থাকে এবং থাকবে।
 
বৃষ্টি হোক, ঝড় হোক, স্নোতে সব সাদা হয়ে যাক- কোন সমস্যা নেই। কাজ চালিয়ে যেতে হবে। নইলে কি আর আমেরিকা?
 
বাসা, অফিস, গাড়ী, ট্রেন সব জায়গায়ই হিটার বা এসি- প্রয়োজন মত চলছে।
শুধু একটু কষ্ট হয় রাস্তায় হাঁটা-চলার সময়; শীত বা গরম শুধুমাত্র তখনই টের পাওয়া যায়। আরেকটা বিষয় আমার নজর কেড়েছে- নিউ ইয়র্কে সুর্য কখনওই মাথার উপর আসে না। উত্তর গোলার্ধে সূর্য সবসময় মনে হয় কোনা-কুনি ভাবেই থাকে, তীর্যকভাবে আলো ও তাপ বিতরণ করে; বিষয়টি ভাল লাগার মতো। আমি নিউ ইয়র্কে আসার পর থেকেই দেখলাম গাছের পাতাগুলো লালচে হয়ে যাচ্ছে এবং ঝরে পরে যাচ্ছে।
 
জানলাম এখানের সব গাছের প্রতিটি পাতাই পরে যাবে এবং গাছগুলো পাতাশূণ্য হয়েই থাকবে বসন্ত না আসা পর্যন্ত।
বরফে ঢেকে সাদা হয়ে থাকবে গাছের পাতাবিহীন ডাল-পালাগুলো। শীতের শেষে গাছগুলোতে প্রথমে ফুল আসবে; তারপর নতুন কচি কচি সবুজ পাতা। ভাবতে ভাল লাগছে। তবে মজার বিষয় হল- এগুলো সম্ভবত সবই সেঞ্চুরী গাছ।
 
নিউ ইয়র্কে অন্য কোন গাছ নেই।
আমাদের আম, জাম, কাঠাল, লিচু, দেবদারু গাছ কিচ্ছু নেই এখানে। কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, নিম গাছ, পেয়ারা, গাব, লিচু, তেতুল অথবা বর্ষার কদমফুল, নেই কোন তালগাছ এক পায়ে দাড়িয়ে, নেই খেজুর গাছ; সত্যি কোন গাছ নেই শুধুমাত্র সেঞ্চুরী গাছ ছাড়া। কয়েকটা জায়গায় ন্যাচারল কাশবন দেখলাম; আমার অতিপ্রিয় কাশফুলও ফুটেছে কিন্তু বাংলাদেশের মতো হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারলোনা এখানকার কাশফুলগুলো; এখানকার কাশফুলগুলো ধবধবে সাদা নয়। একটু অফ হোয়াইট বা গ্রে কালার টাইপের; বাংলাদেশের কাশফুলগুলো বেশ লম্বা টাইপের ও ধবধবে সাদা হয়; এখানকারটা খাটো ও বেঁটে।
 
সোমবার আমার কাজ একটু কম ছিল কিন্তু আগেই জেনে গেছি সারাদিন বৃষ্টি থাকবে।
কি করা যায় ভাবছি; অনেকের সাথেই কথা বললাম। নিউ ইয়র্কের কোথায় গেলে আমার স্বপ্নের আমেরিকার আসল রূপ খুঁজে পাবো সকলের সাথেই আলাপ করে জানার চেষ্টা করছি। এর মধ্যেই কেউ একজন বলল- টাইমস স্কোয়ার নাকি রাতেও জেগে থাকে।
 
ভাবলাম আজই মোক্ষম রাত; যাব টাইমস স্কোয়ার।
এখন আমি নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাট সবই চিনি- বিশেষতঃ সাবওয়ে মেট্রো রুটগুলো; এখন কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা এই নিউ ইয়র্ক শহরে।
 
সিদ্ধান্ত নিলাম আজ রাতে বৃষ্টি থামার পর টাইমস্ স্কোয়ার যাব।
কথামত রাত সাড়ে দশটার দিকে জ্যামাইকা সেন্টার থেকে জে ট্রেন ধরে মাঝখানে ৬ এবং ৭ ট্রেন চেঞ্জ করে ফরটি সেকেন্ড ষ্ট্রিট টাইমস স্কোয়ার এ নেমে গেলাম। প্লাটফর্ম থেকে বের হয়ে মেইন ষ্ট্রিটে আসলাম।
 
একি? কোথায় আসলাম আমি?
এ যে দিনের মতো আলো চারদিকে! নাকি এখন সত্যিই দিন?
আমি কোথাও ভূল করছি না তো? ঘড়ির দিকে তাকালাম- ঘড়িতে রাত ১১.৪৫পিএম, মোবাইলেও।
আকাশের দিকে তাকালাম- রাতের মতোই অন্ধকার। আমি বিস্ময়ে হতবাক।
 
পুরো টাইমস স্কোয়ারটাকে আমার দিন মনে হল।
এতো আলো আমি জীবনেও দেখিনি।
 
দোকান পাট বলতে গেলে সবই খোলা।
অসংখ্যা টুরিস্ট ছবি তুলছে।
 
সত্যি বলছি দিনের মতোই ঝকঝকে আলো চারদিকে।
সুউচ্চ অত্যাধুনিক সব অট্রালিকা। বিজ্ঞাপন বোর্ডগুলো বিশাল।
 
আমার মনটা ভরে গেল।
এই তো আমেরিকা!
এই তো নিউ ইয়র্ক!
 
আমি আজ রাতে বুঝে ফেললাম আমি সত্যি আমেরিকা এসেছি।
এবং এই টাইমস স্কোয়ারেই আজ আমার নিজের অফিসটি অবস্থিত।
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *