এই আমি


কিছুদিন পূর্বে আমার একটা লেখায় উল্লেখ করেছিলাম আমার হাতের অবিশ্বাস্য টাইপিং স্পীড নিয়ে। আজ নিজেকে নিয়ে আরও কিছু মজার(!) গল্প করি, কি বলেন?
ছবি তোলার প্রতি আমার একটা অসম্ভব ঝোক সেই ছোট বেলা থেকেই। তখন তো আর ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না, একটা ফিল্ম কেনা লাগতো ১২০ টাকা দিয়ে। তখনকার আমলের ১২০ টাকা কিন্তু আজকের হিসাবে অনেক; তখন এক হালি মুরগীর ডিম এর মূল্য ছিল ৫ টাকা। কোলকাতায় এক বেলা গরু ভোনা দিয়ে ভাত খেতে বিল উঠতে ৮ রুপি।
কলেজে পড়ি, অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে একটা ক্যামেরা কিনে ফেললাম। তারপর থেকেই আমার ছবি তোলার অভিযান শুরু। মূলত ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৯ সালের মধ্যে আমি বাংলাদেশের প্রায় ৪৩৫টা উপজেলা ভ্রমণ সম্পন্ন করি। একবার গেলাম কুয়াকাটা। গুলস্তান থেকে বিআরটিসি’র বাসে উঠে বসলাম বিকেল ৪টায়। সর্বমোট ১৪টি ফেরী পার হয়ে পরদিন দুপুর ২টায় গিয়ে পৌছলাম কুয়াকাটা। তখন ৪/৫টা হাতে গোনা হোটেল ছিল।
২দিন বেড়িয়ে, কুয়াকাটা থেকে আরেক বিআরটিসির বাসে করে লম্বা সফরে চলে গেলাম খুলনা- সেও এক যন্ত্রণাময় যাত্রা। গেলাম সুন্দরবনের ভেতরে- অনেক ভেতরে যেখানে যাওয়া বারণ!
১৯৯৪ সালে চট্রগ্রাম থেকে বিমানে (জীবনে প্রথমবার) করে চলে গেলাম কক্সবাজার, ভাড়া ছিল ৩৩৫টাকা। কক্সবাজার পৌছে তো দেখি টাকা প্রায় শেষ। অনেক কষ্টে যুব পান্থ নিবাসে সীট জোগার হলো- ৩দিন বেড়ালাম।
কক্সবাজার পৌছে প্রথম যে কাজটা করেছিলাম, সেটা ছিল হোটেলে ব্যাগেজ রেখেই চলে গিয়েছিলাম সী বীচে। না সন্ধ্যার অন্ধকারে সী বীচ দেখার জন্য নয়- গিয়েছিলাম চেখে দিখতে সত্যিই সাগরের পানি লোনা (লবনাক্ত) কিনা?
একবার গেলাম কুড়িগ্রামের রাজীবপুর আর রৌমারী উপজেলায়। বাংলাদেশের সবচে প্রত্যন্ত এলাকা এটি। স্থানীয় একটি নবগঠিত প্রাইমেরী স্কুলের হেড মাষ্টার আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়ে সেই স্কুল পরিদর্শন করালেন- ছাত্ররা স্যালুট দিল, আমি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলাম। প্রচন্ড বিব্রত হয়েছিলাম আমি সেদিন। অযোগ্যকে যোগ্যতা দেয়ার বিব্রতবোধ।
রাজীবপুরের সীমান্ত সংলগ্ন একটি ছোট নদীতে চড়ে (আমি কিন্তু ভাল নৌকা চালাতে পারি) পাড় হয়ে (বালিয়ামারী) চলে গেলাম ভারতীয় সিমান্তের ভেতর। দূর থেকে একজন ‘পাইলট’ এসে আমাকে ধমকে বাংলাদেশে নিয়ে আসলো। দূরে দেখলাম বিএসএফ এর পর্যবেক্ষন আমার উপর।
ওটাই ছিল প্রথম ভারতের মাটিতে পা রাখা। সে যে কি উত্তেজনা আমার?
রৌমারীতে কেউ একজন বলল, কর্ণঝরা নামে একটা জায়গা আছে- ভীষন সুন্দর, দর্শণীয়। জানতে চাইলাম কতদুর? উত্তর পেলাম আট-দশ মাইল। সিদ্ধান্ত নিলাম যাব। রিক্সা নেই, ভ্যান নিলাম। যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। ভ্যানওয়ালাও চিনে না। বেলা ৩টায় ফিরার সিদ্ধান্ত নিলাম।
পরে জানলাম, দূরত্ব অনেক বেশী হলে স্থানীয় লোকজন সেটাকে বোঝায় ‘আট-দশ মাইল’ বলে!
না, আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই। কর্ণঝরা অামি ঠিকই গিয়েছিলাম- তবে সেটা বাজীবপুরে নয়। সেটা জামালপুর আর শেরপুরের সীমান্তঘেরা দুর্গম এলাকা- কিন্তু অতি মনোরম। বাট সেটা অন্য আরেকট টূরে- প্রায় বছর তিনেক পর।
সিলেটে গেলাম মাধবকুন্ডু জলপ্রপাত দেখতে। কেউ তো বলতেই পারে না সেটা কোথায়! অবশেষে জাফলং দেশে সান্তনা মিটালাম।
পরের বার অনেক গবেষনা করে আবিস্কার করলাম, মাধবকুন্ডুটা পড়েছে মৌলভীবাজারের বড়লেখায়। দিলাম রওয়ানা। কুলাউড়ার এক রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে স্থানীয় পাবলিক বাসে করে বড়লেখা যেয়ে ওখান থেকে রিক্সায় করে মাধবকুন্ডু। অনেকটা পরিশ্রম করে ক্লান্ত হলেও জলপ্রপাত দেখে শান্তি পেলাম। স্থানীয় দু/চারজন ছাড়া তেমন কেউ তখন সেখানে যেত না খুব একটা।
জাফলং এ গিয়ে জুতা খুলে অতি পরিষ্কার পানিতে খালি পায়ে একটা ছবি তুলেছিলাম। আমার পা’দুটো নাকি খুব সুন্দর- ছবিটা পায়ের জন্যই নাকি বেশী সুন্দর লাগছিল।
অতপরঃ একবার গেলাম দিনাজপুর বেড়াতে যেয়ে পঞ্চগড় এর বাংলাবন্ধ গেলাম আমার ভাগনী ইভাকে নিয়ে- ও তো তখন পিচ্চি। ওখানে কোথায় যেন পেলাম পাথর আর পরিস্কার জল। ইভা আমাকে ধরলো- সেই জাফলং এর মতো জুতা খুলে এখানে দাড়িয়ে আরেকটা ছবি তুলে দেবে। ওর বায়না মেটানোর জন্যই অনিচ্ছা সত্বেও জুতা খুললাম; ও খুব আনন্দ নিয়ে ছবিও তুলে দিল। কিন্তু প্রিন্ট করার পর বুঝা গেল- সে আমার পা’টাকে বাদ দিয়েই ছবি তুলেছে!
এসব করে করে কখন যে আমার ব্যক্তিগত ছবির পরিমান হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) সেটা তো আমি টেরই পাইনি। আমার সবগুলি ছবিই লেমিটেন করা। কিন্তু ফেসবুক জন্ম নেবার পর আস্তে অাস্তে ছবি তোলার সেই দুর্দান্ত ইচ্ছাগুলি মরে গেল। সেই আবগ আর পাই না। ছবি তুলি কিন্তু খুব একটা প্রিন্ট করা আগ্রহ বোধ করি না। আর আমেরিকায় এসে তো প্রিন্ট করাই হলো না কোন ছবি। সবই ডিজিটাল। ফেসবুক জন্ম নিল সেই ২০০৭ সালে, আমি আমার এই আইডি টি নিয়ে সেই ২০০৭ সালের সাথেই জড়িয়ে রয়েছি ফেসবুকের সাথে; ছবি দেবার পরিবর্তে এখন লিখেই মনে হচ্ছে বেশী আনন্দ পাই।
সেই আবেগটা যদি কোনদিন আবারও ফিরে পেতাম!
খুব ভাল হতো- তাই না।