একটি ছোট গল্প : নীলিমা


১লা জানুয়ারী ২০২১

আজ আর অফিসে যাবো না, গাড়ী নিয়েও বের হবো না। ম্যানহাটনে গাড়ী পার্ক করা খুবই কষ্টকর বিষয়। আর উইক-ডে’তে তো ইমপসিবল।

আমি বাসা থেকে বের হয়ে সোজা সিক্স ট্রেন ধরে ফিফটি-নাইনথ ষ্ট্রিট এন্ড লাক্সিনটন এভিনিউ ষ্টেশনে নামলাম। গেট থেকে বের হয়ে ল্যাক্সিনটন এভিনিউ ধরে সোজা মিনিট পাঁচেক হেটে পৌছে গেলাম সিক্সটিথার্ড ষ্ট্রিট এন্ড ল্যাক্সিনটন এভিনিউ। এখানটায় বেশ কয়েকটা ফুলের দোকান রয়েছে। প্রচন্ড শীত আজ। কাল সারারাত স্নো পরেছে, ফুটপাত সাদা হয়ে রয়েছে। পকেট থেকে হাত বের করা খুবই কস্টকর। আমি একটি ফুলের দোকানে ঢুকে এক তোড়া ফুল নিলাম, লাল টকটকে ফুলগুলো।


কাছেই সাবওয়ে ষ্টেশনে- কার্ড সুয়াইপ করে সোজা ভেতরে ঢুকে গেলাম।
এই সাবওয়ে ষ্টেশনটি কম করে হলেও ২০ তলা সমান মাটির নীচে অবস্থিত। ট্রেনের কাছে পৌছতেও ৫/৭ মিনিট লেগে যায়। এর মধ্যেই একটা টেক্সট পেলাম নীলিমার কাছ থেকে, তাকে বহন করা এফ ট্রেনের সিক্সটি থার্ড ষ্ট্রিট এন্ড ল্যাক্সিনটন এভিনিউ এ পৌছতে আর মাত্র ৩ মিনিট লাগবে। আমি ততক্ষনে এফ ট্রেনের প্লাটফর্মে দাঁড়ানো।


আমি কোনই রিপ্লে দিলাম না।নীলিমা জানে, আমি উপস্থিত আছি। সুতরাং টেক্সট দিয়ে জানানোর কোনই প্রয়োজন নেই।


আগেই বলা ছিল নীলিমা পেছনের দিকে ৩য় বগিতে থাকবে। আমি জায়গা মতোই দাঁড়ানো আছি। ট্রেনের গেট ওপেন হওয়া মাত্র নীলিমা বের হলো। জিনস প্যান্ট, কালো স্নো-বুট এবং ভারী লাল লম্বা ওভার কোট, মাথা একটি সাদা হিজাব দিয়ে মোড়ানো, তার উপর সাদা ওলেন টুপি। কি যে অদ্ভুৎ সুন্দর লাগছে আজ নীলিমাকে।


আমাকে দেখেই ভীষন মিষ্টি করে হাসলো। নীলিমা আগে থেকেই জানে কেন আজ তাকে আসতে বলেছি। আমি আবারও তাকে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ বলে শুভেচ্ছা জানালাম এবং আমি ওর হাতে ফুলের তোড়াটি ধরিয়ে দিলাম। সেই মিষ্টি করে দেয়া হাসিটা আবারও দেখতে পেলাম, খুবই কম কথা বলে নীলিমা। ঐ যে মিষ্টি করে হাসলো- ওটাই তার কথা। আর প্রায়ই আমাকে বলবে, ‘আপনি খুব বেশী কথা বলেন, সারাক্ষন খালি বকবক করেন; কথা কম বলবেন।’ আমি নির্বিকার থাকি ওর এসব কথায়।


নীলিমাকে দেয়া এটাই আমার প্রথম গিফট। সে আমার থেকে কোন গিফট নেয় না, কিছুই নেয় না। দেখাতে চাইলে দেখে- কিন্তু তার বক্তব্য বিয়ের আগে সে কিছু নিবে না। আমি বলি, ‘ঠিক আছে চলো তাহলে, আজই বিয়ে করবো।’ কিন্তু তাতেও সে রাজী হয় না। মাঝে মধ্যে নীলিমাকে আমি সত্যিই বুঝতে পারি না। এই আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়েও আদিম যুগের মেয়েদের মতো ‘আপনি’ ‘আপনি’ করে কথা বলে। এখন আর আমি কিছুই বলি না। চুপচাপ থাকি। ওর যা-ইচ্ছে বলুক, করুক। আমি আর কিছুই বলবো না।


‘এ-ই, তাড়াতাড়ি চলো, তোমাকে দেবার মতো আমার হাতে খুব বেশী সময় কিন্তু নেই।’ আমার দিকে তাকিয়ে ঝাঁজালো গলায় বললো নীলিমা।


আমি ওর মুখে দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেলাম যেন। ও যে আজই প্রথম আমাকে তুমি করে বলল- সেটা কিন্তু আমার নজর এড়ায় নি। আমি বেশ রোমাঞ্চ ফিল করলাম ওর গলায়। কিছু বললাম, না কিন্তু আমার মনটা যেন ভড়ে উঠলো। চিন্তা করলাম, ওকে বুঝতে দিবো না যে আমি ওর ‘তুমি’ করে বলাটা শুনেছি। দেখিই না আর কদ্দুর যায় সে।


‘আমরা কিউ ট্রেন নিবো। কোথাও যেতে হবে না, অপোজিটে প্লাটফর্মেই ডাউনটাউন কিউ ট্রেন আসবে। চলো, ওদিকে গিয়ে দাঁড়াই, ট্রেন আসতে এখনও ২ মিনিট সময় আছে’। বলেই হাঁটতে যাবো, ঠিক তখনই নীলিমা ওর ডান হাত দিয়ে আমার বাঁ হাতটি শক্ত ধরে ফেলল।


আমি বিস্মিত। কোনদিনই আমি এই কাজটি করতে পারিনি। পাক্কা ১ বছরের সম্পর্ক, তার মধ্যে সে দেশে থেকে ইউনাইটেড স্টেটস এ এসেছে ৫ মাস। তার হাত স্পর্শ করাও অসম্ভব। সে কোন গিফট নিবে না। এদেশে হাগ করা বা প্রেমিকাকে কিস করা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। নীলিমা যে আমাকে ভালবাসে সেটা আমিও উপলব্ধি করি, আমি তো বাসিই। অথচ, তার দিক থেকে সবসময়ই আন্তরিকতায় কেমন যেন এক অনীহা।
আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম।স্বপ্ন দেখছি না তো! ওর আজকে কি হলো? আপনি থেকে তুমি, আবার হাতও ধরে ফেলেছে। নীলিমার মুখে এই প্রথম দুষ্টমীর হাসি দেখতে পেলাম। চোখে মুখে কেমন যেন এক মুগ্ধতার আভাস। মিষ্টি মিষ্টি করে হাঁসছে ও।


‘কি ব্যাপার আজকে?’ আমি বললাম, ‘এতো দিন পর সুমতি হলো বুঝি?’
‘কিসের সুমতি আবার! তুমি এতো রিকোয়েষ্ট করো, তাই একটু খুশী করার জন্য হাত ধরলাম, এরচে বেশী কাছে ঘেসলে কিন্তু খবর করে দিবো!’ নীলিমার মুখ থেকে হাঁসি যেন নামেই না। খুবই উৎফুল্ল দেখাচেছ আজ নীলিমাকে। সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন মেয়ে যেন। ‘কাছে আসতে চাইলে- তোমাকে জোরে চিমটি দিবো, চিৎকার করে উঠবো। সুতরাং সাবধান, কাছে ঘেঁসার কোন চেস্টা করবে না। আমি যা ইচ্ছে করবো, তুমি কিছু বলবে না করতেও পারবে না।’


কিউ ট্রেন থেকে আমরা টাইমস স্কোয়ার ষ্টেশনে নামলাম। বের হয়ে সোজা ঢুকলাম এটিএন্ডটির শো-রুমটাতে। বেইজমেন্টে চলে গেলাম একজন সেলস গার্ল এর সংগে কথা বলতে বলতে। আমার সংগে অনলাইনে আগে থেকেই সব সেটেল করা ছিল। আমার ব্যবহৃত আই-ফোনটি ট্রেড-ইন করবো। আর দু’টো নতুন আইফোন টুয়েলভ প্রো ম্যাক্স নিবো। পুরোনো নাম্বারগুলি ঠিক রাখবো।


ওরা কাজ করছে, নীলিমা ঘুড়ে ঘুরে শো-রুমটি দেখছে। আমার কাছে এলো। বললাম, ‘আর কিছু নিবে?’


উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ নিবো।”কি নিবে- বলো?’ জানতে চাইলাম।
আমার চোখের দিকে তীর্যকভাবে তাকালো। মুখ দিয়ে কিছুই বললো না। তাকিয়েই থাকলো। আমিও ওর দিকে তাকালাম। দু’জন দু’জনের দিকে। কতক্ষন ঠিক বলতে পারবো না।


পেছন থেকে ষ্টোর ম্যানেজারের ডাক পেয়ে ফিরে তাকালাম।’স্যার, তোমাদের জন্য একটা বিশেষ অফার রয়েছে- যেটার জন্য তুমি ইলিজিবল। তুমি চাইলে এই প্যাকেজের সংগে দু’টো আইপ্যাড নিতে পারো। ওয়ানটাইম দাম পরবে ১০০ ডলার করে। আর মাসিক আনলিমিটেড ফাইভ-জি ইন্টারনেট ডাটা পাবে মাত্র ১০ ডলারে। এই টোটাল ডাটা তোমরা তোমাদের আইফোনের সংগেও শেয়ার করতে পারবে। এটা বেশ ভালো অফার; আমি তোমাকে এটা নেবার জন্য পরামর্শ দিবো।’


অফারটি সত্যিই দারুণ। আমি খুশী হলাম। সম্মতি জানালাম। ম্যানেজার চলে গেল সবকিছু রেডী করতে।


শো-রূমে আমাদের কাজ শেষ হলো। চারটি প্যাকেট ধরিয়ে দিলো আমাদের হাতে, সবকিছু বুঝিয়ে দিলো। আমি নীলিমার হাতে ওর জন্য নেয়া কালো রঙ এর আইফোন টুয়েলভ প্রো ম্যাক্স এর প্যাকেটটি এগিয়ে দিলাম।


নীলিমা মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।প্যাকেট ওপেন করে ফোনটি বের করলো নিজেই। তারপর আমাকেই ফোন করলো ওর নাম্বার থেকে। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো, ‘ফোনটি রিসিভ করো।’


আমি ওর কল রিসিভ করলাম। দু’জন পাশাপাশি আমরা, এর মধ্যে ফোন কলের কি প্রয়োজনীয়তা বুঝলাম না। তাও রিসিভ করলাম। নীলিমা ফিসফিস করে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’। বলেই লাইন কেটে দিলো।


আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম।মনে হলো যেন লজ্জায় একটু লাল হয়ে গেছে ওর ফর্সা মুখটা।


আমরা বের হলাম, ওকে বললাম, ‘চলো কি খাবে?”আমার যে দু’টো জরুরী কাজ আছে, কাজগুলো শেষ করে তারপর খাবো।’


‘কি কাজ তোমার আবার। আজ তো কোন কাজ থাকার কথা ছিল না।’ আমি মনে মনে একটু রাগই হলাম, যদিও ওকে বুঝতে দিলাম না।


‘ও তুমি বুঝবে না। হাদারামরা এসব বুঝে না’। নীলিমার চোখ মুখে দুষ্টমীর আভা। ‘চলো, একটু টাইমস স্কোয়ার এ দাাঁড়াবো ৫ মিনিট- ওখানেই কাজ।’


অমি একটু অবাকই হলাম।ওতো এমন না। আজ কি হলো নীলিমার। কথা বললাম না। নীলিমা নিজেই আবারও আমার দিকে হাত বাঁড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘হাত ধরো না কেন? হাত না ধরে কি হাঁটা যায়?’


এবার আমি নীলিমার কোমল হাতটি ধরলাম। দুজনের ১০টি আঙুল জড়িয়ে গেল যেন। ১ মিনিট সামনে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে টাইমস স্কোয়ারের চত্ত্বরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সারাক্ষনই এই জায়গাটা মানুষে ভরা। কত মানুষ যে আছে এই পৃথিবীতে- ভাবাই যায় না। টাইমস স্কোয়ারে আসলেই আমার মনটা অন্য রকম হয়ে উঠে। তারউপর আজ নীলিমা সংগে। আজকের মুহুর্তটাই কেমন যেন সম্পূর্ণ অন্যরকম।


নীলিমা বলল, ‘একটা কথা বলবো, শোন।’আমি ওর কাছে আসতেই সে দু’হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এমনটা আমি নীলিমার থেকে কোন কালেও আশা করিনি। সে যা করলো- তার সম্পূর্ণ তার চরিত্রের বিপরীত। জড়িয়ে ধরে নীলিমা আমাকে লিপ-কিস করতে থাকলো। আমি চমকে উঠলাম। কতক্ষন ছিলাম ওভাবে মনে নেই। শুধু একটা কথাই মনে পড়লো- ‘প্রথম ভালোবাসা এবং প্রথম চুমুর মাঝখানের সময়টুকুই হচ্ছে প্লাটনিক লভ’।


নীলিমার মুখটা আমার দিকে তুলছেই না। আমি দু’হাত দিয়ে ওর সুন্দর মুখটা আমার দিকে মেলে ধরলাম। চোখ বন্ধ করে থাকলো মেয়েটি। বললাম, ‘তাকাও আমার দিকে’।


নীলিমা একটু পরই তাকালো, তারপর আবারও চোখ বন্ধ করে ফেললো। তারপর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল, ‘যাহ! মহিষ, খরগোস, বিড়াল, কাঠবিড়ালী’।


আমি হেসে দিলাম। বললাম, আরেকবার হবে?আমার দিকে চোখ লাল করে তাকালো। মানেটা হলো শক্ত করে বড় একটা না।


‘বুঝলাম, তোমার একটা কাজ শেষ হলো। তো, মেমসাহেব দ্বিতীয় কাজটা কি- জানতে পারি। আমার তো ক্ষুধা লেগেছে।’ জানতে চাইলাম নীলিমার কাছে।


নীলিমা একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, এটাতে একটা ঠিকানা রয়েছে- এখানে যাবো। কাজটা শেষ করে তারপর খাবো। তার আগে কিছু খাবো না। আমি ঠিকানাটা নিলাম।

141 Worth StreetNew York, NY 10013


গুগলে এড্রেসটি লিখলাম কিসের ঠিকানা এবং কিভাবে যাবো তা দেখতে।


ঠিকানাটা টাইপ করতেই স্কিনে ভেসে উঠলো, ‘ম্যারিজ ব্যুরো, নিউ ইয়র্ক সিটি ক্লার্ক অফিস’।


আমি নীলিমার দিকে তাকালাম।মাথা নীচু করে রয়েছে। বললাম, ‘আজ ওখানে কেন? কেউ আসবে?’


আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মহিষ, খরগোসটা বুঝেও না ওখানে কি হয়? চলো আমার সংগে, হাত ধরে নিয়ে চলো আমাকে।’


আমরা দু’জনে হাত ধরে সাবওয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *