একটি নির্ভেজাল ছোট গল্প


কিউ ফোরটি-ফোর বাস ধরে পিয়া’র এখানেই এসে দাঁড়ানোর কথা।

গতরাতে আমি ওকে ই-মেইল করেছি। কোন উত্তর পাইনি। অবশ্য আমি জানি ও আমার ডাক অবহেলা করতে পারবে না। সুতরাং অন্য কোনভাবে যোগাযোগের চেষ্টা না করে আমি ঠিক ৯টায় জায়গা মতো এসে দাঁড়ালাম। মেইন ষ্ট্রিট এন্ড ইউনিয়ন টার্নপাইক এ অবস্থিত চেজ ব্যাংকের সামনে আমি গাড়ীটা পার্ক করে বসে আছি। ও আসবে আমি জানি।পিয়া বরাবরই ভীষন পাংচুয়েল যদিও আমি একটু অগোছালো। নয়টা ১৫তে আসতে বলেছি এখানে। দেখা যাক আজ কি হয়? এবং ঠিক ৯টা ১২ মিনিটে একটা কিউ-ফরটি-ফোর আর্টিকুলেটেড বাস এসে থামলো; আমার এখান থেকে পরিস্কার দেখা যায় গাড়ীর রিয়ারভিও মিররে, প্রিয়া নামছে। আমি কিছুই না দেখার ভান করে বসে রইলাম।

কয়েকবার এদিক ওদিক দেখে সে আমার গাড়ী দেখতে পেয়েছে। আসছে। ডানপাশে গাড়ীর গেটটা যখন খুলে ও ভেতরে পা রাখলো তখন ঘড়িতে ঠিক ৯টা ১৫ মিনিট। আমার দিকে তাকালো না। সীটবেল্ট বাঁধলো বসেই। কোন কথা নেই আমাদের।গাড়ীতে ষ্টার্ট দেয়াই ছিল, আমি গ্যাসে পা দিলাম। সোজা ইউনিয়ন টার্নপাইক ধরে গ্রান্ড সেন্ট্রাল পার্কওয়েতে উঠলাম, সোজা ৮০তে স্পীড উঠিয়ে দিয়ে ছুটছি। কোন কথা নেই- কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছি না। ৯-ই তে এক্সিট নিয়ে হোয়াইট-ষ্টোন এক্সপ্রেস ওয়ে’তে চালাচ্ছি।

হোয়াইট-ষ্টোন ব্রীজ পার হয়ে ১৯এন ধরে সোজা আই-৯৫ এ উঠলাম। আমি আপন মনে গাড়ী ড্রাইভ করছি; যেন কোন দিকেই আমার কোন খেয়াল নেই। এমন একটা ভাব নিচ্ছি যেন গাড়ীতে আমার সংগে অন্য কেউ নেই- আমি একা। ‘আমার ক্ষুধা লাগছে, ১০টা প্রায় বাজে আমি না খেয়ে আছি।’ আমার দিকে না তাকিয়েই একটু জোরে বলে উঠলো পিয়া। ‘ক্ষুধা তো আমারও লাগছে- আমি কি কিছু খেয়েছি?’ সামনের দিকে তাকিয়ে আমি আপন মনে বললাম নিজে নিজেই। আবার কিছুক্ষন দু’জনেই চুপচাপ। নিউ রোসেল হয়ে গ্রীনউইচ পার হয়ে স্ট্যাম্পফোর্ডের উপর দিয়ে ছুটছি- ৯০ থেকে ১০০’র উপরে স্পীডে।

জিপিএস এ পুলিশ এলার্ট পেলেই শুধুমাত্র ৭০এ স্পীড নামিয়ে আনছি কিছু সময়ের জন্য- পুলিশ যাতে বুঝতে পারে একজন নম্রভদ্র নিরীহ লোক ড্রাইভ করছে!

‘আমি যে বললাম আমার ক্ষুধা লাগলে- কেউ কি শুনে না?’ আবারও চিৎকারের মতো করে উঠলো পিয়া।

আমিও বলে উঠলাম, ‘বললাম তো আমারও ক্ষুধা লাগছে? এখন কি করবো আমি? এখানে তো কোন রেষ্টুরেন্ট দেখছি না’।

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ জানতে চাইলো সোজা সামনের দিকে তাকানো সুন্দরী মেয়েটি- আমার পাশেই বসা। হাতে আইফোন এইট রেড। ইউটিউবে কোন গান খুঁজছে। এবং তখনই বাজতে শুরু করলো: ‘পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনে, পাগল আমার মন ….’

পিয়া জানে এই গানটি আমার খুবই পছন্দের।

আমাকে আনন্দ দিতে কখনওই মেয়েটি চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখে না।

আবারও বলে উঠলো, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘জানি না, দেখি না কোন পর্যন্ত যাওয়া যায়।’

‘আমি কিন্তু রাত থাকতে পারবো না, কাল আমার কাজ রেখেছি।’

‘আমি কি বলেছি যে আমরা রাত থাকবো?’

‘তাহলে কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘বললাম তো জানি না।’

‘জানি না মানে কি? কোথায় যাচ্ছি বলো না কেন?’

‘দেখি কোথায় যাওয়া যায়। এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেই নি।’

নরওয়াল্ক, মিলফোর্ড ছাড়িয়ে আই-৯৫ ধরে বাঁদিকে নিউ হ্যাভেন রেখে আমার গাড়ী ছুটে চলছে সোজা, ডানপাশে আটলান্টিক মহাসাগড়।

‘আমরা কি নিউ লন্ডন যাচ্ছি?’

‘বললাম তো জানি না, এটা কানেকটিক্যাট- এটুকুই শুধুমাত্র জানি।’ ঠান্ডা মাথায় বললাম আমি।

তখনই লক্ষ্য করলাম সামনেই একটা ‘সার্ভিস প্লাজা’। আমি গাড়ী রাইট এক্সিট নিয়ে সার্ভিস প্লাজায় ঢুকিয়ে দিলাম। গাড়ীতে গ্যাস ভরে, পার্কিং লটে পার্ক করলাম।

বললাম, ‘নামো।’

ইঞ্জিন অফ করে গাড়ী থেকে নেমে পা বাড়াতেই পিয়া আমার ডান হাতটি ওর নরম হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ফেললো, চোখে পানি, কাঁদছে। কোন কথা বলছে না। এই একটা জায়গাতেই মেয়েরা একজন শক্ত পুরুষকেও দুর্বল করে দেয়। আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম ‘কাঁদে না, শান্ত হও। সব ঠিক হয়ে যাবে’।

‘তুমি বলছো- সব ঠিক হয়ে যাবে? সত্যি?’

‘হ্যাঁ, বলছি তো।’ ম্যাকডোনাল্ডস এর টিস্যুবক্স থেকে একটা টিস্যু বের করে ওর চোখ মুছিয়ে দিলাম। বললাম, ‘কি খাবে বলো? ম্যাকডোনাল্ডস না কি অন্য কিছু?’

‘আমি তো সবই খাই, তুমি কোনটা খাবে বলো?’ আমি কথা না বলে ম্যাকডোনাল্ডস এ কিউই’তে দাঁড়ালাম। ‘অর্ডার করো’ বলেই ক্রেডিট কার্ডটি ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম।

অর্ডার শেষে খাবারের ট্রে’টা হাতে করে একটা খালি টেবিলে বসা আমি, পিয়া আমার জন্য খাবার রেডী করে দিচ্ছে। আমি বসে বসে ওর খাবার রেডী করা দেখছি।

‘নাও, হা করো।’ আমার মুখের কাছে খাবার এনে বলল পিয়া। আমি হা করলাম। ‘বলছো না কেন কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ আবারও জানতে চাইলো।

‘কোথাও না; লং ড্রাইভ। একটু পরেই রিটার্ণ করবো- দেখি না কদ্দুর যেতে ভালো লাগে?’ বললাম আমি।

‘একটু পরেই রিটার্ণ করার দরকারকি? রাত ১১টার মধ্যে বাসায় ফিরতে পারলেই চলবে; আমাকে তুমি সময়ই দিতে চাওনা!’

খাওয়া শেষে রেষ্টরুমে যেয়ে ফ্রেস হয়ে আবার গাড়ীতে গিয়ে উঠলাম।

আই-৯৫ ধরে কানেকটিক্যাটের বুক চিড়ে ছুটে চলছি আমরা। পিয়া এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কথা বলছে।

বলল, ‘আচ্ছা ইভান তুমি আমাকে এতোটা কষ্ট দাও কেন একটু বলবে? আমি কি তোমাকে ভালবাসি না? তুমি কি জানো গত ৬টা দিনে আমি কত শতশতবার শুধু তোমার জন্য চোখের পানি ফেলেছি? তুমি আমার সংগে দেখা করো না, আমাকে সময় দাও না, আমার ফোন রিসিভ করার সময়ই নেই তোমার। এটা কেমন রিলেশন একটু বলবে?’

‘আবার শুরু করলে?’

‘একটু অভিযোগও করতে পারবো না আমি?’ ওর চোখে আবারও পানি।

‘এই যে আবারও শুরু হলো! একটু বাইরে বের হয়েছি কি একটু হৈচৈ করবো, মজার মজার কথা বলবো- তা না আবারও কান্না শুরু করে দিলো! আশ্চর্য্য!।’

‘ঠিক আছে আর অভিযোগও করবো না আমি, এই দেখো। আচ্ছা একটা কথা বলো- তোমাকে যে আমার সবসময় কাছে পেতে মন চায় সেটার কি সমাধান? তুমি অন্তত ৭ দিনের মধ্যে ১দিন তো আমাকে দিবে- নাকি সেটাও না?’

‘দিচ্ছি তো, আজ আমি কোথায়?’

‘এখন ১১টা বাজে। সকালে ৬টা থেকে সময় দিতে তো পারতে, আসলে সাড়ে নয়টায়!’

‘সাড়ে নয়টায় নয়, সোয়া নয়টায়’।

‘ওই হলো, একই।’

সামনেই এক্সিট-৫৫ নর্থ ব্রান্ডফোর্ড, আমি রাইট ইন্ডিকেটর দিলাম, ৫৫ এ এক্সিট নিলাম। অতপর ইষ্ট মেইন ষ্টিট ধরে কিছুটা যেয়ে জিপিএস কে ফলো করে রাইট-এ পার্কিং এ ঢুকিয়ে দিলাম গাড়ীটা।

‘কোথায় যাচ্ছো ইভান? আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে যেতে তোমার কি কোন অসুবিধে আছে?’ প্রশ্নের স্ট্যাইলে পাল্টা উত্তর করলাম।

‘না না। ছি্ এভাবে বলছো কেন? জানতে চাইছি- কৌতুহল?’

‘দেখি কোথায় যাওয়া যায় এখানে’। বললাম।

গাড়ীতে বসেই ‘মোটেল-সিক্স ব্রান্ডফোর্ড’ এর ছোট্ট সাইনবোর্ডটি দেখা যাচ্ছে।

পিয়া’র চোখ ঝলকে উঠলো। ‘হোটেল?’ চিৎকারের মতো শোনালো ওর কন্ঠে। প্রচন্ড উচ্ছসিত সে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে আমাকে ওর দু’চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলছে যেন। ‘তুমি এটা আগেই বুকিং দিয়ে রেখেছিলে, অথচ আমাকে বলোনি? আমাকে জানিয়ে বুকিং দিলে আমি কতটা খুশী হতাম সেটা কি তুমি বুঝো না?’

‘কিভাবে বলবো তোমাকে? গত ৬দিন আমাদের কোন কথাই তো হয় নি।’

‘কাল রাতে যে ইমেইল দিয়েছিলে সেখানেও তো বলতে পারতে।’

‘পারতাম। কিন্তু তাহলে তোমার চোখে এখন যেই দ্যুতিটুকু আমি দেখতে পাচ্ছি- সেটুকু তো আর দেখা হতো না।’

‘যাহ্ শয়তান।’

‘কি? বাদ দিবো হোটেল-মোটেল? তারচে চলো এখানেই একটা খুব বড় ষ্টেট পার্ক আছে- চলো ওখানটায় না হয় সারাদিন ঘুড়ে বেড়াই। হোটেল বাদ থাকুক।’ আমি হাসি হাসি মুখে বললাম।

‘তোমাকে কিন্তু আমি মেরেই ফেলবো; চলো তো!’ ওর চোখের এখনও সেই দ্যুতিটুকু যেন ঝরে পড়ছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *