দোহা থেকে উড়াল দিয়ে কাতার এয়ারওয়েজ এর বিমানটি প্রায় ১২ ঘন্টার আকাশপথ পাড়ি দিয়ে কানাডার পূর্ব দক্ষিন আকাশ-সীমা পেড়িয়ে আমেরিকান আকাশ ছোঁয়ার মুহুর্তেই বিমানের ক্যাপ্টেন ঘোষনা দিয়ে জানালেন ‘ওয়েলকাম টু দ্য ইউনাইটেড ষ্টেটস’।
এই মুহুর্তটির জন্যই কিনা দীর্ঘ প্রায় বছর পনের ধরে মনের ভেতরে কি এক অজানা তৃষ্ণা আমাকে জালিয়ে খাচ্ছিল!
সে যাই হোক- সে গল্প তো আপনাদের আগেই বলেছি; আজ অন্য কথা বলি।
প্রায় ৪০ হাজার ফুট উপর থেকে দেখতে আমেরিকাও যা বাংলাদেশও তাই-ই; নীচের বাড়ীঘরগুলি তেমন একটা বোঝা যায় না, নীচে সবই সবুজ বা সাগর হলে গাঢ় নীল। কিছু ঘরবাড়ী দেখলেও সেটাকে ছোট ছোট ইটের মতোই লাগে।
এই পৃথিবীর ১০টি ব্যস্ত এয়ারপোর্টের মধ্যে ৩টিরই অবস্থান মার্কিন মুল্লুকে; বাকী ৭টি এয়ারপোর্টের ৪টিতেই আমি কম করে হলেও সবমিলিয়ে ৫০ থেকে ৬০ বার ল্যান্ড করেছি বা সেখান থেকে ফ্লাই করেছি, অন্যান্য ছোট-বড় আরও গোটা ৪০শেক এয়ারপোর্টও আমার অতি পরিচিত, অতি চেনা। সুতরাং আমি যদি বলি আকাশের বিমান এবং মাটিতে বিমানবন্দর এই দু’টোই আমার চোখে ডাল-ভাতের মতোই তাহলে সেটাকে নিশ্চয়ই ‘বাড়াবাড়ি’ বলাটা মোটেও উচিৎ হবে না; কি বলেন?
আর এই বিশ্বের অনেক বড় বড় শহর, শহরের সাবওয়ে বা মেট্রো সার্ভিস, এক শহর থেকে অন্য শহরের ট্রেন সার্ভিস বা বুলেট ট্রেন কিংম্বা তাদের এক্সপ্রেস ওয়েতে চলাফেরারও ঢের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, করতে পেরেছি।
অর্থাৎ একটা উন্নত দেশের সার্বিক উন্নয়নের অবকাঠামো দেখার, বোঝার সৌভাগ্য আমার রয়েছে।
সিংগাপুরের চাংগি থেকে স্যাংহাই এর পুডং আমার অতি পরিচিত রুট হলেও, দ্বিতীয় একজন বাঙালী আমার চোখে কখনওই পড়েনি ওসব ফ্লাইটে।
কাজেই আমার মতোই, আমার চোখদু’টিও সবকিছু আলাদাভাবেই দেখে, বুঝে; আমি বুঝতে চেষ্টা করি আর মাঝে মধ্যেই চোখ বন্ধ করেও দেখতে ভালবাসি। দেখি।
তো, আমেরিকার আকাশে উড়তে উড়তে আরও বেশ কয়েক ঘন্টা বাদে বুঝতে পারলাম আমাদের বহন করা বিমানটি এবার নীচের দিকে মাটিতে নামতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমারও কৌতুহল বাড়ছে- কখন দেখবো বিশ্বের সর্বউন্নত মাটির দেশটি!
আমেরিকার মাটিতে নেমে নিশ্চয়ই আমার এক অন্যরকম অনুভূতি জন্মাবে- একটা মহাউন্নত দেশ! মাটির প্রতিটি পরতে পরতে উন্নতি দেখতে পাবো! সে কি উত্তেজনা আমার। এই উত্তেজনা তো আমি পোষন করে এসছি বিগত কম করে হলেও ১৫টি বছর।
হংকং এ ল্যান্ড করার মুহুর্তে দক্ষিন চীন সাগরে খুব নীচু দিয়ে উড়ে যাবার সময় নিজেকে পাখির মতো মনে হতো, পুডং এ ল্যান্ডিং এর সময় মনে হোতো- এমন এক শহরে নামছি যেখানে তৈরী হয় এই বিশ্বের সকল উন্নতির মেশিনারীজ। কিন্তু আজ তো নামতে যাচ্ছি জেএফকে এয়ারপোর্টে। এই পৃথিবীর মাথা এটা। অজানা শিহরণ তখন আমার শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায়।
কুয়ালা লামপুরের কেএলআইএ এবং কেএলআইএ-টু এয়ারপোর্টদু’টি বা বেইজিং এর এয়ারপোর্টটিতেও নামার সময়ও প্রথম প্রথম মহাউন্নতির পরশ অনুভব করতাম।
নীচে জেএফকে’র রানওয়ে। আমাদের বহনকারী কাতার এয়ারওয়েজ এর বোয়িংটি নামার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতেছে। আমি নীচে দেখছি। নিউ ইয়র্কের ছোট ছোট লাল ইটের দালান কোঠা- ফাঁকা ফাঁকা। গ্রামের মতোই রাস্তাঘাট। আমার হতাশা বাড়ছে- ক্যাপ্টেন কি ভুল এয়ারপোর্টে চলে এলো নাকি!
বিমানটির চাকা মাটি স্পর্শ করলো। আমি টার্মিনাল ভবন দেখতে পাচ্ছি- খুবই ব্যস্ত একটা এয়ারপোর্ট প্রতি মিনিটে নাকি ৪টি বিমান উঠানামা করারও রেকর্ড রয়েছে এখানে।
বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে যাচ্ছি!
কিন্তু এসব আমি কি দেখছি! ঢাকা এয়ারপোর্ট এর পরিধিও তো আরও একটু বড় মনে হয়েছে আমার কাছে। সেখানেও দু’একটা দোকান-পাট রয়েছে, আরেকটু খোলা-মেলা! এই নাকি মহা উন্নতির দেশ! আমি পুরোপুরি হতাশ (তখন তো বুঝিনি যে এখানে ৮টি আলাদা আলাদা বিশাল বিশাল টার্মিনাল রয়েছে)।
একটা ইয়োলো ক্যাব নিয়ে আমার পূর্ব নির্ধারিত ভাড়া বাসায় যাবো, রাস্তার দু’পাশের কাঠের তৈরী বাড়ী-ঘর দেখে আমার হতাশা তখন চরমে! এই তাহলে নিউ ইয়র্ক শহর! এরম একটা পচাঁ শহর নাকি আমেরিকার সবচে বড় শহর! কি দেখছি এসব?
হংকং, দুবাই, সিংগাপুর, বেইজিং, সিউলও তো এরচে ঢের উন্নত! দীর্ঘ ভ্রমনে ক্লান্ত আর উন্নতির দারিদ্র দেখে হতাশ আমি। সপ্তাহ খানেক আমি ভেবেই পাইনি- এটা কেমন উন্নত দেশ হলো!
নিউ ইয়র্কের মাটির নীচে রয়েছে আরও একটা শহর; আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক সিটিকে চিনতে শুরু করছি। মাটির নীচের সাবওয়ে ট্রেনে উঠে প্রথম দিনই আমি হারিয়ে গেলাম। রাস্তা গুলিয়ে ফেললাম। কোন দিক দিয়ে আসলাম আর কোন দিক দিয়ে বেরুবো- খুঁজেই পাচ্ছি না।
কিভাবেই বা পাবো?
আমি তো আসলে তখনও ‘উন্নত রাজ্যে শুধুই একজন কচি খোকা; স্রেফ বালক’!
বেইজিং, স্যাংহাই, হংকং, সিংগাপুরের সাবওয়ে ট্রেনে নিয়মিত চড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি এতবছর নিজেকে বেশ বড়ই ভেবে বসে ছিলাম। এমাথা থেকে ওমাথা অবধি অত্যাধুনিক ট্রেন ও একজোড়া মাত্র ট্রেন লাইন নিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করা এই আমি নিউ ইয়র্ক সিটির সাবওয়ে রাজ্যের ২২ জোড়া ট্রেন লাইনে ঢুকে তো হারাবোই!
কেন হারিয়ে গেলাম সেটা বুঝতে বাসায় ফিরে যখন ইন্টারনেটে নিউ ইয়র্ক এমটিএ সাবওয়ে সিষ্টেম দেখলাম- তখন আমি বুঝতে পারলাম এযাবত কাল আমি ‘উন্নতি’ শব্দটির অর্থও শিখিনি। স্রেফ একজন নাবালক আমি এই প্রকৃত উন্নত দেশটিতে। বড় বড় কয়েকটা ভবন আর আধুনিক রাস্তাঘাট ও নতুন নতুন ট্রেন হাকিয়ে উন্নতি হয় না।
আজ থেকে শোয়াশত বছর আগে এরা মাটির নীচ দিয়ে ২২ জোড়া ট্রেন লাইন তৈরী করেছে যখন কুয়ালা লামপুর ছিল একটা বড় জঙ্গলাপূর্ণ অঞ্চল। আজ থেকে একশত বছরেরও আগে এরা তাদের শহরের রাস্তাঘাটের যে ডিজাইন করে রেখেছে তা আমি এই বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাইনি!
মাত্র ২৩ স্কোয়ার মাইল ম্যানহাটন আইল্যান্ডটি ব্রুকলিন, কুইন্স, ব্রঙ্কস ও নিউ জার্সির সংগে সংযুক্ত করা হয়েছে প্রায় ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন ডাবল-ডেকার ব্রীজ, সাবওয়ে টানেল, সাবওয়ে, রেল টানেল দিয়ে এবং এগুলি সবই তৈরী করা হয়েছে ১০০ বছরেরও বেশী আগে।
আরও ১০০ বছর পরও আমার আগের দেখা দেশগুলি ‘এতটা’ ডেভলেপমেন্ট করতে পারবে না- আমেরিকা ইতিমধ্যেই যা করে রেখেছে!
কিন্তু আমার খটকা অন্য জায়গায়। আমার খটকা অন্যত্র।
আমি ‘উন্নতি’ বলতে ইতিমধ্যে ‘অন্যকিছু’ বুঝে ফেলেছি- এবং আমেরিকা তথা উন্নতদেশগুলি আসলে সেই ‘অন্যকিছু’র চর্চাকেই উন্নত বা উন্নয়ন হিসাবে চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এবং এই ‘আসল’ উন্নতি বিষয়টা না বুঝলে- উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করাও বৃথা।
বড় বড় টানেল, ব্রীজ, সাবওয়ে, আর বিশাল বিশাল ভবন তৈরী করে আসলে ‘প্রকৃত উন্নয়নের ছোঁয়া’ অর্জন করা কোন কালেও সম্ভব নয়।
উন্নয়ন করতে হবে মানুষের, মানুষত্বের।
আর তখনই আপনি নিজেকে ‘উন্নত’ ভাবতে পারবেন।
আপনি বা আপনার স্ত্রী কিংম্বা অতিপ্রিয় সন্তানটি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পরেছে হঠাৎ, হাতে কোন টাকা নেই। কি করবেন? কারো কাছে টাকাও চাইতে পারচ্ছেন না। অসুখ-বিসুখ তো আর জানান দিয়ে আসে না। কি করবেন এখন? ব্যাথায় কাঁতরাবেন? আপনার সন্তান ব্যাথায় কাঁতরাচ্ছে আর আপনি অসহায় পিতা তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন! কি করবেন আপনার উন্নত রাস্তাঘাট, ব্যীজ-টানেল আর বড় বড় ভবন দিয়ে?
এটা যদি আমেরিকা হয়- তাহলে আপনার কোন টেনশন নেই। যাষ্ট নাইন-ওয়ান-ওয়ানে একটা কল করুন। বাকিটা হসপিটাল করবে। আপনার কাছে একটা পয়সাও চাবে না তখন- আগে আপনার চিকিৎসা; আগে আপনাকে সুস্থ করে বাড়ীতে ফেরত পাঠাতে হবে। এটা নিশ্চিত করাকে বলা হয় ‘উন্নয়ন’।
আপনার দেশে কি সেটা রয়েছে? রয়েছে চায়নাতে? কোরিয়াতে? সৌদী আরবে? সিংগাপুরে? দুবাই-এ?
না। নেই। সেই সুযোগ, সেই উন্নতি ঘটিয়েছে আমেরিকা। ইওরোপ। এটাকে উন্নয়ন বলে।
আপনার দেশের ভুখন্ডে একজন ছোট মানুষ্য-সন্তানও অসহায় অবস্থায়, অবহেলিত হয়ে পরে থাকবে না। সে যে বাবা-মায়ের সন্তানই হোক না কেন? নিজ অথবা ভিন্ন যে-কোন দেশ, মাটি, জাতি, কমিউনিটি বা চরম শত্রুর সন্তানই হোক না কেন। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে খাবার, পোষাক, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব কি আপনার রাষ্ট্র নেয়?
নেয় আপনার বাংলাদেশ? নেয় কি সৌদী আরব, কাতার, চায়না, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, রাশিয়া কিংম্বা ভারত-পাকিস্তান?
না নেয় না।
এই গুরু দায়িত্ব পালন করে আমেরিকা, কানাডা, ইওরোপ। এবং এটাকেই উন্নয়ন বলে।
একজন মানব-সন্তান তার ১৮ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত এবং তার হাইস্কুল পাশ করে কর্মক্ষম হওয়া পর্যন্ত তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে রাষ্ট্র। এটুকুই যদি রাষ্ট করতে না পারে- তাহলে রাষ্ট্র রেখে লাভ কি?
লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে, ছোট করবো।
ভূমি বা মাটি নিয়ে দেশ হয় না; দেশ হয় মানুষ নিয়ে- এই বাস্তবতাকে যতক্ষন না পর্যন্ত আপনি বুঝতে সক্ষম হবেন ততক্ষন পর্যন্ত আপনার দ্বারা কোন উন্নয়ন সম্ভব হবে না। এবং এই প্রতিটি মানুষকে দিতে হবে সমান অধিকার। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের কাজ হবে প্রতিটি মানুষের প্রাপ্ত অধিকার নিশ্চিত করা। এবং তখনই আপনি দাবী করতে পারবেন আপনার দেশটি উন্নত হয়েছে।
পারবে আপনার বাংলাদেশ এই দাবী করতে? পারবে সৌদী আরব বা চায়না বা তুরস্ক? চায়নার তো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলায় উদৃত্ব রাজস্ব। সৌদী আরবের তো টাকা রাখারই জায়গা হয় না। এরা কি উন্নত হতে পেরেছে? পারবে কোনদিনও?
আকাশ থেকে ঢাকাকে লস এনজেলেস এর মতো দেখায়, বিস্ময়কর উন্নয়ন হচ্ছে দেশে, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ আমেরিকাকে উন্নয়নে ছাড়িয়ে যাবে, উন্নয়নের রোল মডেল- এসব যারা প্রতিনিয়ত গলা ফাটিয়ে বলে বেড়াচ্ছে- এরা প্রকৃতপক্ষে তেলাপোকার চেয়েও অযোগ্য, মুর্খ, অশিক্ষীত। নীতিহীন, নোংড়া মানসিকতাপূর্ণ চতুরতা নিয়ে প্রতিনিয়ত বোকা বানিয়ে যাচ্ছে ১৭ কোটি মানুষকে।
‘উন্নতি’ বা ‘উন্নয়ন’ কি এবং কিভাবে হয়- সেই জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতাও যাদের নেই আজ তারাই বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে। নিজেকে উন্নয়নের রোল মডেল বলে পরিচয় দিচ্ছে।
নিউ ইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়া যেতে হয় আমার প্রতি সপ্তাহে প্রায় দু’বার করে। প্রতিবার আসা যাওয়ার দূরত্ব প্রায় ২৫০ মাইল বা ৪০০ কিলোমিটার। ঘড়ি ধরে পাক্কা ৪ ঘন্টা আমার খরচ হয় নিজে ড্রাইভ করে আসা-যাওয়ায় এই আড়াইশত মাইল পথ। নিউ ইয়র্ক থেকেই আমি ক্লায়েন্টকে বলে দিই রওয়ানা হবার সময়- ঠিক কয়টায় পৌছবে সেখানে।
আপনি পারবেন ঢাকা থেকে সিটাগং রওয়ানা হবার পূর্বে কয়টায় পৌছবেন তা আপনার ক্লায়েন্টকে কমফার্ম করতে? পারবেন কি আরও ১০০ বছর পরও? পারবেন না।
আপনি তো মিরপুর থেকে রওয়ানা দিয়ে সদরঘাট পৌছতে কয়টা বাজবে সেটাও জানেন না- কিভাবে পারবেন?
চলুন সভ্যতা ও উন্নয়ন বোঝার চেষ্টা করি- তারপর নিজেকে ‘রোল মডেল’ পরিচয় দেয়া দূরে থাক ‘রোল মডেল’ শব্দটির অর্থ বুঝেন কি না সেটা নিয়ে আলোচনা করি।