স্পীড


আমি কোনদিনও মোটরসাইকেল চালাইনি।
খুব ছোট বেলায়, স্কুলে পড়ি যখন বেশ ভালই সাইকেল চালাতাম; কিন্তু কোনদিনও মোটরসাইকেল চালানোর ইচ্ছে হয়নি।
 
গাড়ীর প্রতি দুর্বলতা ছিল খুব ছোট বেলাতেই।
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি, কিন্তু তারপরও চিন্তায় আমি বরাবরই উচ্চবিত্তেরও উপরে ছিলাম। যখন স্কুলে পড়ি তখনই আমার চিন্তায় ছিল কবে গাড়ী হবে আমার।
 
যাই হোক, গাড়ী হলো, ব্যক্তিগত ড্রাইভারও হলো কিন্তু নিজে তো ড্রাইভিং জানি না।

তাও ভালো, ড্রাইভারকে নিয়ে এদিক ওদিক যাই। ড্রাইভার নিজেই একদিন বলল, ‘স্যার, গাড়ী চালানো তো বেশ সহজ- আমি আপনাকে শিখিয়ে দিই- আপনি চালান।’

ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় তো আমি সাহস করতেই পারছিলাম না। অবশেষে ২০০৪ সালের দিকে গ্রামের বাড়ীর সামনে আমাদের খেলার মাঠে গাড়ী নিয়ে নামলাম। ড্রাইভার আমাকে বেসিক কিছু বিষয় দেখিয়ে দিল। আমিও দেখলাম বেশ সহজ। গাড়ীর নিয়ন্ত্রণ নিলাম, ড্রাইভার আমার পাশে বসা- সমস্যা হলে সে হ্যান্ড্রেবক দিয়ে গাড়ী থামাতে পারবে।

আমি মাঠ ছেড়ে রাস্তায় উঠে আসলাম।
বেশ চালাচ্ছিলাম। আমাদের বাড়ীর সামনেই একটা ছোট নদী এবং সেই নদীতে একটি ব্রীজও ছিল। কিন্তু ভারী বৃষ্টিতে ব্রীজে উঠার রাস্তাটির মাটি দুই পাশ থেকে সরে যাওয়া ওটুকু রাস্তা বেশ সুরু হয়ে গেছে।

আমিও ড্রাইভ করে ব্রীজে উঠতে যাবো, আর ঠিক তখনই বিপরীত দিক থেকে একটি রিক্সায় দুইজন ভদ্রমহিলা (তাদের একজন বৃদ্ধা এবং অপরজন প্রেগনেন্ট) কে নিয়ে একজন বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা ওই সরু রাস্তায় নেমে এসেছে এবং সামনেই আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বেশী টেনশনে ব্রেক কষার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম। আমার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা কাজ করছিল একটা একসিডেন্ট এবং দু’জন ভদ্রমহিলার মৃত্যু। ভাগ্যিস আমর ড্রাইভার পাশে বসা ছিল এবং সময়মত সে গাড়ী থামাতে পেরেছিল।

সেই ২০০৪ সালের সেই সন্ধ্যায় আমার বোধদয় হয়েছিল যে গাড়ী চালানো অন্ততপক্ষে আমার দ্বারা সম্ভব হবে না কোন কালেও। সেই শেষ। আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুরা সকলেই পরামর্শ দিতো ড্রাইভিং শেখার; এমনকি কেউ কেউ লজ্জাও দিতো নিজে ড্রাইভ করতে পারিনা বলে। কিন্তু আমি যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে ড্রাইভিং আমি শিখবোই না। 

দু’বার জীবনে বিপদেও পরেছি ড্রাইভারের অভাবে, আবার সমস্যা মিটেও গেছে- হঠাৎ পাওয়া সহযোগীতায়। তারপরও নিজে ড্রাইভ করতে রাজী ছিলাম না আমি।

 
যাই হোক, ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলাম গেল ডিসেম্বরে এই নিউ ইয়র্ক শহরে এসে ২০১৮তে- এই বৃদ্ধ বয়সে এসে।
 
আমেরিকায় আসার আগে কোনদিনও ভাবিনি যে আমি নিজে কোনদিন ড্রাইভ করবো, তবে নিজে ড্রাইভ করতে পারবো না বলে- এই গাড়ীর দেশে আমার নিজের গাড়ী থাকবে না, এটা ভেবে মনটা সবসময়ই কেমন কেমন করতো।
 
নিতান্তই অনিচ্ছা সত্বেও ড্রাইভিং শিখি, কিন্তু শেখার পর বেশ মজা পেয়ে যাই।
 
আফসোস হচ্ছে, কেন যে ঢাকাতে বসবাসকালীন সময়ে মনের ভয়টাকে দূর করে গাড়ী ড্রাইভিংটা শিখলাম না!
 
বিএমডব্লিও ফোর-হুইল-ড্রাইভ সেডান কারটি নেবার পর গেল তিনমাসে অলরেডী সাত হাজার মাইল ড্রাইভ করেছি। সুবিধে হলো আমার বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব ১৭ মাইল- সে হিসাবে প্রতিদিনই কম করে হলেও ৩৫ মাইল রাস্তা ড্রাইভ করা হয়। আর বোনাস হিসাবে এই মাত্র ৩ মাসেই নিউ ইয়র্ক, পেনসালভ্যানিয়া, নিউ জার্সী, কানেকটিক্যাট ষ্টেটগুলি চষে বেড়িয়েছি।
 
নতুন ড্রাইভার। তবে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী মানুষ হিসাবে ড্রাইভিংটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিই এবং মনে হচ্ছে বেশ ভালোই উৎরে যচ্ছি।
 
নিউ ইয়র্ক সিটির ভেতরে যখন ড্রাইভ করি, বিশেষ করে মিডটাউন ট্যানেল এবং বাংকার ব্লুলেভার্ড এক্সপ্রেসওয়েতে ড্রাইভ করে খুবই মজা পাই। নিউ ইয়র্ক স্টেটের ম্যাক্সিমাম স্পীড লিমিট ৫৫ মাইল হলেও এই দু’টি এক্সপ্রেসওয়েতে (সিটির ভেতরে যদিও স্পীড লিমিট মাত্র ২৫ মাইল) আমি ৮০ মাইল স্পীডে ড্রাইভ করি।
 
বলতে গেলে ওটাই আমার ম্যাক্সিমাম স্পীড।
তবে যখনই নিউ ইয়র্ক স্টেটের বাইরে যাই, বিশেষ করে আই-৯৫ দিয়ে যখন ড্রাইভ করি তখন আমার এভারেজ স্পীড দাঁড়ায় ১০০ মাইল/ ঘন্টা। আমি সবসময়ই ফাষ্ট-লেনে গাড়ী ড্রাইভ করে আনন্দ পাই।
 
যাই হোক ফিরে আসি মোটরসাইকেল প্রসংগে।
আমেরিকার উত্তরাঞ্চল শীতপ্রধান হওয়ায় নিউ ইয়র্ক বা আশ-পাশের স্টেটগুলিতে সাধারণ মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। কিন্তু তারপরও সামারের সময়টাকে বেশ কিছু সৌখিন চালক দেখা যায় দুর্দান্ত সব মোটরসাইকেল ড্রাইভিংএ।
 
মোটা মোটা চাকার উচ্চ আওয়াজের ওসব কালো রঙের মোটরসাইকেল দেখতেও মজা। আমেরিকার রাস্তায় মোটরসাইকেল দেখে প্রায়ই ভেবেছি একবার চেষ্টা নিবো কি না! কি সব বাহারী ডিজাইনের মোটরসাইকেল এক একটা- চিন্তারও বাইরে। কিছু মোটর সাইকেল রয়েছে যা প্রায় ৩৫/ ৪০ হাজার ডলারেরও বেশী দাম।
 
প্রচন্ড আওয়াজ তুলে খুবই দ্রুত গতিতে দল বেঁধে ছুটে চলে এসব মোটরসাইকেল ইন্টারস্টেট এক্সপ্রেসওয়ে ধরে। জিপসী স্টাইলে এগিয়ে চলে এদের একএকটি গ্রুপ। ভয়ংকর সুন্দর সেসব মোটরসাইকেল চালনা। একেকটি দলে মোটামুটি ১৫ থেকে ২০টা মোটরসাইকেল দেখা যায়।
 
হাইওয়েতে ড্রাইভ করার সময় আমি প্রায়ই ওদের বহরে গিয়ে পরি।
আমি সাধারণত ওদের সংগে একটু তাল মিলিয়ে চলতে পছন্দ করি।
 
নিউ ইয়র্ক সিটির ভেতরে মিডটাউন ট্যানেলে মাঝে মধ্যেই দেখি কয়েকটা টিনএজ ব্লাক ছেলেকে দু’চাকার মোটরসাইকেলের সামনের চাকা আকাশে তুলে শুধুমাত্র পেছনের চাকায় ৮০ মাইল স্পীডে এগিয়ে চলে, ৮০ মাইল যে স্পীড- সেটা আমি বুঝি কারণ আমিও যে তখন ওদের বহরে ঢুকে পরি সমান তালে। এভাবে পেছনের এক চাকার উপর মোটরসাইকেল চালানোকে নাকি হাউডী বলে!
 
যাই হোক গতকাল যাচ্ছিলাম ওয়াশিংটন, মেরীল্যান্ড, ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়া হয়ে আই-৮১ সাউথ এক্সপ্রেসওয়ে ধরে। রাস্তাটাও বেশ ফাঁকা। হঠাৎ মাথায় আসলো নিজের স্পীড বাড়ানো দরকার, কতদিন আর ৮০ থেকে ১০০ তেই আটকে থাকবো?
 
খেয়াল করিনি যে আমার পাশাপাশি দু’টো মোটরসাইকেলও ছুটে চলতে একই গতিতে।
 
নিজের স্পীড বাড়াতে থাকলাম।
১২০ মাইল স্পীডে নিজেকে তুলে বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। ১২০ মাইল কিন্তু বাংলাদেশের হিসাবে ১৯২ কিলোমিটার/ ঘন্টায়। গাড়ীটিও মাশাল্লাহ আমার কথা যেন বুঝতে পারে। বাঁকগুলোতেও ১২০ চালানো যেন কোন বিষয়ই না। তাছাড়া লেনের পর লেন চেঞ্জ করে অন্য সব গাড়ীকে পেছনে ফেলে অতি দ্রুত বেগে এগিয়ে যাওয়ার মজাটাও তো অতুলনীয়। প্রায় আধ ঘন্টারও বেশী ওভাবেই ১২০ এ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ওয়েজ এপস বলে দিচ্ছিল আশে-পাশে বা সামনে কোন পুলিশ বা হিডেন পুলিশও ছিল না। 
 
যে-ই আমি ১২০ স্পীডে তৃপ্তীর ঢেকুর তুলবো- ঠিক তখনই ওই মোটরসাইকেলদু’টি আমাকে বৃদ্ধঙ্গুলি দেখিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে অতিক্রম করে চলে গেল সামনে। আমার গাড়ীর ম্যাক্সিমাম ১৬০ মাইলের কাটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবলাম, বেশী বাড়াবাড়ি করাটা ঠিক হবে না। 
 
আমি ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে নায়ক থেকে দর্শক হয়ে গেলাম মুহুর্তেই!


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *