সৌন্দর্য্য আর আনন্দ


যতটা মারাত্মক ভেবেছিলাম ততটা ব্লেজার্ড হয়নি।
স্নোও পরেছে আশংখার তুলনায় কম।
 
একজন ক্লায়েন্ট ফোন করলেন- অফিসে আসতে চাচ্ছেন। আসতে বললাম।
 
আমিও রেডী হয়ে বের হলাম বাসা থেকে।
বের হয়েই হোচট খেলাম। তখনও মধ্য হালকা বৃষ্টির স্টাইলে স্নো পরছে। এমনিতে যখন স্নো পরে তখন ততটা শীত উপলব্ধি হয় না। কিন্তু আজ মনে হলো শীতের তীব্রতাও বেশ। সংগে হালকা বাতাসও।
 
হ্যান্ড গ্লাভস, কানটুপি পরে নিয়ে ছাতা হাতে বের হলাম।
আমার বাসা থেকে সাবওয়ে স্টেশনে পৌছতে প্রায় মিনিট দশেক সময় লাগে।
 
বাসা থেকে বের হয়ে বুঝতে পারলাম আজ অন্য কেউ এই বিল্ডিং থেকে বের হয়নি- স্নো যেভাবে জমেছে ঠিক তেমনি রয়েছে। কারো পায়ের চিহ্ন নেই। গেটও স্নোতে আটকে রয়েছে।
 
পা দাবালে মনে হলো প্রায় ১০ ইঞ্চ নীচে মাটি।
আমার পায়ে স্নো বোট, কাজেই ভয় কম। নিজেই গেটের সামনের জমে থাকা স্নো পা দিয়ে সরিয়ে দিলে গেট খুলে বের হলাম। ফুটপাত পুরো আট থেকে দশ ইঞ্চ স্নোতে ঢেকে রয়েছে। পা ফেললেই দেবে যাচ্ছে।
 
ওভাবেই হাঁটছি। সবকিছু সাদা।
অদ্ভুৎ সুন্দর লাগছিল। শক্ত হাতে ছাতা ধরে রেখেছি।
 
মিনিট পাচেক হাঁটার পরই হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার চোখদুটো যেন কেমন করছে- দেখতে কষ্ট হচ্ছে।
 
মনে পরলো বেয়ার গ্রেইল এর কথা। ভদ্রলোক যখন বরফের রাজ্যে হাঁটতেন তখন তিনি তার চোখটা ঢেকে রাখতেন- নইলে নাকি সাদা দেখতে দেখতে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
 
বিষয়টা আমাকে হতবাক করলো।
সাদা বরফের দিকে একটানা তাকিয়ে হাঁটা চলবে না বুঝতে পারলাম। এভাবে সৌন্দর্য্য দেখতে থাকলে চোখই হারাতে হবে।
 
সব সৌন্দর্য্য সবার চোখে সয় না।
 
রাস্তাগুলিতে গাড়ীর সংখ্য অত্যন্ত কম। বেশীরভাগ দোকানই বন্ধ। মানুষও অনেক কম।
সত্যি বলতে আজই প্রথম আমি নিউ ইয়র্কে কোন ডেজাষ্টারের পর বাইরে যাবার ঝুঁকি নিচ্ছি।
 
ঝুঁকিটা ইচ্ছাকৃত।
নিজের চোখে বোঝা- এখনকার আফটার ডেজাষ্টার লাইফটা ঠিক কতটা সচল থাকে তা দেখা।
 
আগেই ঘোষনা দেয়া হয়েছে স্কুলগুলি বন্ধ থাকবে।
 
প্রায় হাঁটু সমান স্নো পার হয়ে হাঁটতে একটু কষ্ট এবং অত্যন্ত সতর্কতা নিয়ে হাঁটছি। দু’টি কারণে আমি বেশী সতর্ক থাকছি। প্রথমত স্নোতে আঁচরে পরে গেলে নির্ঘাৎ এই বুড়ো বয়েছে হাত-পা ভেংগে বসে থাকতে হবে। এবং দ্বিতীয়তঃ ‘কেউ একজন’ আমাকে (এই বিষয় নিয়ে আমার একটা লেখা রয়েছে- জ্যোতিষী) সবসময় সতর্কতার সঙগে হাঁটাচলা করার পরামর্শ দিয়ে রেখেছে।
 
আমি কোন ঝুঁকি নিতে রাজী নই।
 
যেই রাস্তাটুকু ১০ মিনিটে পাওয়া যায়- সেটা আজ প্রায় ২০ মিনিট লাগলো। ক্যাসেল হিল সাবওয়ে ষ্টেশনে পৌছে দেখলাম সিরি নীচেই লাল ফিতা দিয়ে আটকানা এবং একটু পর পর ঘোষনা দেয়া হচ্ছে যে সিক্স ট্রেন আজ ক্যাসেল হিল ষ্টেশনে চলছে না।
 
সিদ্ধান্ত নিলাম আরও একটু হেঁটে পার্কচেষ্টা সাবওয়েতে যাবো। ওখান থেকে নিশ্চয়ই ট্রেন চলছে অথবা অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে।
 
আরও প্রায় একই রকম স্নো পেরিয়ে এগিয়ে চলছি।
 
নিউ ইয়র্ক সিটির ময়লা পরিস্কারের গাড়ীগুলি সামনে স্নো অপসারন যন্ত্র লাগিয়ে চলাচল করছে আর স্নো পরিস্কার করে রাস্তা গাড়ী চলাচল উপযোগী রাখছে। এক মিনিটের জন্যও প্রধান রাস্তা বন্ধ থাকবে না।
 
পার্কচেষ্টার পৌছে দেখলাম সেখানেও ট্রেন চলছে না।
ইনফরমেশন ডেক্স জানালো বিএক্স ফোর বাসে করে হান্টস পয়েন্ট যেয়ে ওখান থেকে সিক্স ট্রেন চলছে।
 
বিএক্স ফোর বাসে করে হান্টস পয়েন্ট পৌছলাম। ওখান থেকে সাবওয়ে সিক্স ধরে ম্যানহাটনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
 
ঠিক সন্ধ্যায় অফিসে কাজ শেষে এক বন্ধুকে নিয়ে গেলাম রুজভেল্ট আইল্যান্ডে। দেখতে আজকের এই ডিজাষ্টরে সেখানে কি ‘ক্ষতি’ হয়েছে।
 
পৌছলাম।
কয়েকটা ছবি তুললাম, যা একটা একটু আগেই পোষ্ট দিয়েছিলাম।
 
যে বিষয়টা বুঝতে কোন সমস্যা হলো না তা হলো- একটা গোছানো, নিয়ন্ত্রিত এবং সভ্য শহরে ডিজাষ্টার হয়ে যাবার পর তার আরও বেশী সৌন্দর্য্য প্রকাশিত হয়ে উঠে।
 
অসাধারণ লাগছিল রুজভেল্ট আইল্যান্ডকে আজ।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম রুজভেল্ট আইল্যান্ডের সৌন্দর্য্য প্রায় ৩০ মিনিট ভরে।
 
মনে পরে গেল ছোট বেলার কথা।
 
হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টিতে আতকে উঠতাম। বাড়ীতে টিনের চালে বৃষ্টির সংগে ঝড়ের মধ্যে অন্যরকম কষ্টকর আনন্দ উপভোগ্যও ছিল। কিন্তু ভয় হতো বেশী বাতাস হলে। বড় বড় গাছগুলি ভীষন রকমভাবে হেলে দুলে পরতো।
 
এর মধ্যে শীলাবৃষ্টি হলে বৃষ্টির মধ্যেই বের হতার শিলা কুড়াতে। সেকি আনন্দ। স্বাদহীন সেই সাদা শিলাও কি তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে ফেলতাম।
 
ঝড়-বৃষ্টি শেষ হবার পর দ্রুত বের হতাম আম কুড়াতে।
কে কত বেশী আম কুড়াতে পারে। তাজা আম কুড়ানোর মজাই আলাদা।
 
আম কুড়ানো শেষ হলে অনেক সময় অথবা বেশী বৃষ্টি হলে সেই বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে গোসল করে নিতাম।
 
তারপর বৃষ্টি ঝড় পুরোপুরি থেমে গেলে হালকা গড়ম কাপড় গায়ে দিয়ে বের হতাম গ্রাম দেখতে কোথায় কি কি ক্ষতি হয়েছে।
 
কোথাও শুনতাম বজ্যপাতে কারো কস্টকর মৃত্যুর কথা। কোথাও দেখতাম বড় কোন গাছ উপড়ে পরেছে- কয়েকজন মিলে সেই গাছ সরিয়ে দিয়ে রাস্তা চলাচলের উপযোগী করতে সচেষ্ট হতাম।
 
কোথাও কাঁচা মাটির রাস্তা বৃষ্টির পানির চাপে ভেংগে গেছে।
আবার কোথাও সেই বৃষ্টির আটকে থাকা পানির স্রোত নেমে চলছে নীচের দিকে।
 
এবং সেই সামান্য বৃষ্টির পানিতেও কয়েক ঘন্টা পরই দেখা মিলতো ছোট ছোট কিসব মাছও জন্ম নিয়েছে।
 
সেই আনন্দ আজ এই নিউ ইয়র্কে খুঁজে পাইনি।
সৌন্দর্য্য আর আনন্দ কখনওই এক না।
 
এক হতে পারে না।
আনন্দ ভেতর থেকে আসে, আর সৌন্দর্য্য চোখ জুড়ায়।
 
গ্রামের বৃষ্টির পরে ধুয়ে মুছে যাওয়া সেই রাস্তা, গাছ-পালারও কিন্তু আলাদা সৌন্দর্য্য ছিল যা প্রাণও জুড়াতো।
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *