সেই দেশটি!


সাইনবোর্ড থেকে হারিকেন যেতে কতক্ষন লাগে?
 
হাসার মতো কিছুই বলিনি।
 
যাত্রাবাড়ী শনিরআখড়া’র পরে ঢাকা সিটাগং হাইওয়ে ধরে আরও কিছুটা এগুলে নারায়ণগঞ্জ এর দিকে যে রাস্তাটা টার্ণ নিল সেই মোড়টার নাম ‘সাইনবোর্ড’। সম্ভবত কোনও এক অদূর অতীতে এখানে কোন সাইনবোর্ড ছিল বিধায় স্থানটির নাম সাইনবোর্ড হয়ে যায়।
 
এবং টংগী থেকে গাজীপুরের দিকে যেতে থাকলে ঢাকা ময়মনসিংহ রোডের একটা স্থানের নাম ‘হারিকেন’। এই বস্তুর নাম কে, কিভাবে, কবে, কখন নির্ধারণ করিল তাহা নিশ্চয়ই গবেষণার বিষয়।
 
আমার চন্দ্রিমা উদ্যান, জিয়া উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, জিয়া উদ্যান থেকে আবারও চন্দ্রিমা উদ্যানে থিতু হয়েছি।
 
যমুনা সেতু থেকে বঙ্গবন্ধু ব্রীজ আবারও যমুনা সেতু, শেষটায় আবারও বঙ্গবন্ধু ব্রীজ দেখেই চলছি।
 
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মুর্হূতেই শাহজালালে পরিণত হতে দেখেছি। ঠিক যেমনটা এক রাতেই ‘আইপিজিএমআর’ হয়ে গেল ‘বিএসএমএমইউ’!
 
ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়কটি অপ্রয়োজনে ১১ নম্বরে পরিণতি অর্জনের কোনই যুক্তি বা সৌন্দর্য বহন করেনি।
 
হংকং এর প্রতিটি চৌরাস্থায় দাঁড়ালে একটা চমৎকার দর্শন ছোট সাইনবোর্ডের মতো দেখতে পাবেন এবং সেখানে আঞ্চলিক ম্যাপ একে প্রতিটি রাস্তর নাম দেয়া রয়েছে এবং ইন্ডিকেট করা রয়েছে ‘ইউ আর হেয়ার’। আপনি চাইলেও হংকং এ হারিয়ে যেতে পারবেন না!
 
আর নিউ ইয়র্কে যদি আসেন তাহলে আপনার ১, ২, ৩ জানা থাকলেই হয়ে গেল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাস্তাগুলি মুলতঃ ষ্ট্রিট এবং এভিনিউতে ক্রস করেছে।
 
যেমন ষ্ট্রিট ৪২, এভিনিউ ৬। কিংম্বা ষ্ট্রিট ৩৪, এভিনিউ ১২। অথবা ষ্ট্রিট ১২৫, এভিনিউ ২। ম্যানহাটনে ১ থেকে ১২ পর্যন্ত ১২টি এভিনিউ রয়েছে। আর লওয়ার ম্যানহাটন বাদ দিলে ষ্ট্রিটগুলি ১, ২, ৩, ৪ এভাবে আপটাউন এর দিকে ব্রঙ্কস পর্যন্ত কমবেশী ৩০০ পর্যন্ত ষ্ট্রিটে উঠে গিয়েছে। অন্যন্য বরোগুলিতেও নিয়মের ব্যতয় ঘটেনি। ষ্ট্রিট, এভিনিউ ছাড়াও, প্যালেস, রোড, ব্লুলেবার্ড ইত্যাদিও রয়েছে ক্ষেত্রভেদে। এখানে কোন কোন ষ্ট্রিট বা এভিনিউকে নামেও নামাংকিত হয়েছে কিন্তু তাতে সিরিয়ালের কোন হেরফের ঘটায়নি।
 
নিউ ইয়র্কে আমরা ‘আপনি এখন ঠিক কোথায় আছেন?’ প্রশ্নের উত্তরে বলে থাকি ‘৭৬ ষ্ট্রিট এন্ড ৩৭ এভিনিউতে’। অর্থাৎ ৭৬ নাম্বার ষ্ট্রিটটি ঠিক যেখানে ৩৭ নাম্বার এভিনিউকে ক্রস করেছে ঐ ক্রসিংটার নামই হবে ‘সেভেনটি সিক্সথ ষ্ট্রিট এন্ড থার্টি সেভেন্থ এভিনিউ’। একটু উপর দিকে তাকাবেন এবং সাইন লেখা দেখবেন ইন্ডিকেশন দিয়ে বলা রয়েছে ষ্ট্রিট ও এভিনিউ নাম্বারগুলি।
 
আপনাকে এখানে সাইনবোর্ড বা হারিকেন খুঁজতে হবে না।
কাউকে হয়রান হয়ে জিজ্ঞেসও করতে হবে না যে, ‘ভাই তালগাছওয়ালা সাত তলা বাড়ীটা কোন দিকে?’ আপনি হয়তো জানেনও না যে তালগাছটি কেটে সেখানে অনেক আগেই কদবেল গাছও লাগানো হয়েছিল।
 
আমাদের কৈশরে আমরা ‘মাইল’ শব্দটির সংগে পরিচিত ছিলাম, ব্যবহার করতাম ‘সের’ এর হিসাব। এরশাদ মিঞা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাইল উঠিয়ে দিয়ে কিলোমিটার এবং সের উঠিয়ে দিয়ে কিলোগ্রাম হিসাব চালু করলেন। ট্রাম্পারেচারের ফারেনহাইট হিসাব উঠিয়ে দিয়ে প্রতিস্থাপন করলেন সেলসিয়াসকে।
 
কিন্তু কেন?
খুব বেশী কি জরুরী ছিল?
এরশাদ এখনও জীবিত আছেন- তাকে প্রশ্ন করুন, ‘কেন করেছিলেন?’
আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি এরশাদ কোন যুক্তিযুক্ত উত্তর দিতে পারবেন না।
 
এরশাদের উত্তর হবে, ‘পৃথিবীর সব দেশ করছে, ভারত-পাকিস্তান করছে তাই আমিও করছি’!
 
বাংলাদেশটা চলছে যুক্তিহীনভাবে, যুক্তি ছাড়া চিন্তা-ভাবনায়।
 
‘সের’ এর হিসাবটি ছিল একান্তই দেশীয় হিসাব পদ্ধতি।
দেশীয় ‘বাংলা সাল’কে যদি আমরা ভালবাসতে পারি- তাহলে দেশীয় পরিমাপের একক আমরা তুলে দিবো কেন?
 
পোয়া, আধসের, একসের, সোয়াসের এসব তো আমাদের ঐতিহ্যেরই অংশ।
আমাদের অ, আ, ক, খ, ১, ২, ৩, ৪ এর মতোই বাঙালী জাতিসত্বার অবিচ্ছেদ্দ অংশবিশেষ।
 
চেতনাবাজরা অবশ্য এসব জানেও না।
 
যাই হোক, এই পৃথিবীর অনেকগুলি দেশ, শহর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে ঘুরে বেড়াবার সুবাদে আমি বলতেই পারি- বিদেশী কোন কিছু গ্রহন করা দোষনীয় কিছু না। বরঞ্চ সেটা যদি যুক্তিযুক্ত এবং অধিক সুবিধা প্রদানে সক্ষম হয় তাহলে সেটা গ্রহণ করাই অধিক মঙ্গলজনক।
 
মাইল ব্যবহার হচ্ছে দূরত্বের একক হিসাবে।
আপনি যখন ড্রাইভ করবেন, এক প্রান্ত থেকে ছুটে চলবেন অন্য প্রান্তে তখন ‘লম্বা দূরত্ব’কে ছোট করাতেই মনস্তাত্তিক আনন্দ বেশী। সেক্ষেত্রে কিলোমিটার নয় বরং মাইল ব্যবহার করাটাই অনেক অনেক বেশী যুক্তিযুক্ত এবং আনন্দদায়ক।
 
আবার আপনি যখন কেনা-কাটা করবেন কোন কিছু; সেটার পরিমাপ আপনার ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে উঠে যদি ব্যবসায়ীর স্বার্থের অনুকুলে থাকে- তবেই না অর্থনীতি বেশী সচল থাকবে। সেই হিসাবে কিলোগ্রাম নয়- পাউন্ডের মাপই যুক্তিযুক্ত।
 
‘১ কেজি বিফ না কিনে ১ পাউন্ড বিফ’ একটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অনেক বড় অবদান রাখতে পারে। আরও বিশদ ব্যাখ্যা দিচ্ছি না, পাঠক লম্বা লেখায় ধৈর্য হারাতে পারেন।
 
আমরা ফারেনহাইট ছেড়ে সেলসিয়াসে গিয়েছি।
খুব ভালো। কিন্তু তাহলে, থার্মোমিটারে সেই ফারেনহাইট ব্যবহার করছি কেন? কেন এখনও শরীরের তাপমাত্রা ফারেনহাইট দিয়ে গণনা করছি? দু’মুখো আচরণ কি যুক্তিযুক্ত?
 
বাংলাদেশের অারও একটা চরম বিরক্তিকর বিষয় এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। বাংলাদেশে কোন একটা বিল্ডিং এ দ্বিতীয় তলাকে বলা হয় ফাষ্ট ফ্লর, তৃতীয় তলাকে সেকেন্ড ফ্লর। ২৫তম তলাকে বলা হয় টুয়েন্টি ফোর্থ ফ্লর!
 
আশ্চর্য্য!
কোন বেকুব এইসব বিরক্তিকর, বাজে, যুক্তিবুদ্ধিহীন সিষ্টেম চালু করেছিল এদেশে?
 
আর শেষটায় বলছি, এই বাংলাদেশেই সম্ভব চাকুরীতে কোটা প্রথার প্রচলন করা!
 
যে দেশে জায়গার নাম হয় হারিকেন, সাইনবোর্ড!
যে দেশে পঞ্চম তলাকে বলা হয় ফোর্থ ফ্লর!
যে দেশে সেলসিয়াস এককে শরীরের তাপমাত্রা হয়ে যায় ফারেন হাইটে!
 
শুধুমাত্র সেই দেশেই সম্ভব যোগ্যতার মাপকাঠিতে নয়, যুক্তির মাপকাঠিতে নয়- নারী কোটায়, জেলা কোটায়, মুক্তিযোদ্ধার পোলাপান-নাতিপুতি কোটায়, উপজাতি কোটায় চাকুরী বিতরণ করা!
 
আর এই বিতরণকৃত চাকুরীজীবিরাই পরবর্তী প্রজন্মকে ‘জিপিএ পাইপ’ বানিয়ে দিচ্ছে!
 
এবং অবশেষে সেই দেশেই একজন জ্বলজ্যান্ত পুরুষ মানুষকে নপুংসক করে বসানো হয় প্রেসিডেন্ট পদবী দিয়ে বঙ্গভবনে!
 
সেই দেশটার নাম বাংলাদেশ।
সেই দেশেই খুঁজে পাবেন হারিকেন, সাইনবোর্ড!
 
আর সেদেশের ১৮ কোটি মানুষ তা মেনেও নেয়!