ল এন্ড অর্ডার


একটা দেশ কতটা উন্নতি করবে বা পিছিয়ে যাবে সেটা নির্ভর করে সে দেশের ‘প্রচলিত আইন’ ও সেই আইন পালনের আন্তরিকতার (বাধ্যবাধকতার) উপর।

এই পৃথিবীতে যে-দেশগুলিই আজ উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে- সে দেশগুলিতে গেলে আপনি দেখতে পাবেন সেখানকার আইনগুলি খুবই সুন্দর, বাস্তবতা-যুক্তি ও নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন। এবং আরও দেখতে পাবেন আইনগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে।

আইন মানার বা সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের আইন মানানোর বাধ্যবাধকতার কারণে এসব দেশে কেউ সামান্যতম আইনও অমান্য করার কথা ভুলেও চিন্তা করে না। আমার তো মাঝে মধ্যে মনে হয় এদেশে একটা পাখিও আকাশে উড়ার সময় দশবার ভেবে নেয় আইন অমান্য হচ্ছে কি না!

আমার নিজের কথা বলি, দেশে থাকতে কখনওই ড্রাইভ করতাম না। হতে পারে এটা আমার স্মার্টনেসের অভাব কিন্তু বাস্তবতা ছিল প্রচন্ড কর্ম ব্যস্ত দিনাতিপাত করতাম এবং সারাক্ষন এতো বেশী কাজের চাপ ও মোবাইল এর অত্যাচার ছিল যে ড্রাইভিং এ কনসেনট্রেট করতে পারতাম না।

তাছাড়া বাংলাদেশে যেহেতু মাত্র দশ-বারো হাজার টাকার বেতনে ফুলটাইম ড্রাইভার পাওয়া সম্ভব সুতরাং নিজে সাহেব হয়ে বসে থাকাতেই বেশী আনন্দ। ড্রাইভার গেট খুলে দেবে, বাজারের ব্যাগ আমাকে ধরতে দেবে না- এসব ভাব নিয়ে থাকাতেও আনন্দ!

আমেরিকায় একজন ড্রাইভার অনায়াসে মাসে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার ডলার ইনকাম করতে পারে। সুতরাং ড্রাইভার রাখার চেয়ে এদেশে নিজেই ড্রাইভার হতে বেশী ভালবাসে।

আমেরিকায় পার্সোনাল ট্রান্সপোর্ট ছাড়া নিজেকে পুরো এতিম মনে হয়। এদেশে গড়ে মানুষের চেয়ে গাড়ীর সংখ্যাই বেশী।

বাংলাদেশে ড্রাইভিং করতাম না। সুতরাং এখানে ড্রাইভিং শিখতে হলে কতগুলি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

যাই হোক, ড্রাইভিং স্কুলে ট্রেনিং নেবার সময় যেভাবে আইনগুলি শেখানো হয় এবং তাতে শুধুমাত্র অন্ধ এবং উম্মাদ না হলে কোন গাড়ী আমেরিকার রাস্তায় এক্সিডেন্ট হওয়া সম্ভব না।

বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি জনমানব অথবা গাড়ী শূন্য অলি-গলির ছোট চৌরাস্তায় পর্যন্ত ৩ সেকেন্ড গাড়ী থামাতে হয়- ক্যামেরা ট্রাফিক পুলিশ কারোরই কোন অস্তিত্ব না থাকা সত্বেও ১টা বারের জন্য কেউ ভাবেও না যে ৩ সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে চলে যাই। কারণ সকলেই জানে কোন এক্সিডেন্ট হলে প্রকৃত দোষী এদেশে ধরা পরবেই এবং তার প্রাপ্য শাস্তি তাকে পেতেই হবে।

রাস্তায় সামান্য ভুল হলে ‘টিকেট’ চলে আসবে বাসার ঠিকানায়।

ম্যাক্সিমাম রোডে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় ও স্বনিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা। নিউ ইয়র্ক সিটিতে গাড়ী ম্যাক্সিমাম স্পীড ২৫ মাইল। ক্যামেরায় যদি ধরা পরে গাড়ী বেশী স্পীডে চলছে- সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই ক্যামেরার সার্ভার থেকে গাড়ীর ডিজিটাল নাম্বার প্লেট স্কানিং করে অটোমেটিকভাবেই জরিমানার টিকেট প্রিন্ট হয়ে যাবে এবং পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে পৌছে যাব তার বাড়ীর ঠিকানায়।

১ সেকেন্ড ভুল করে কে দুই-চারশ ডলার জরিমানা দিতে চাবে?

নিউ ইয়র্কের রাস্তায় ভুলেও কেউ আইন অমান্য করে না।
গাড়ী পার্কিং এর জন্যও রয়েছে নির্ধারিত স্পট এবং মিটার। সপ্তাহের কোন কোন বারে কতটা থেকে কতটা পর্যন্ত এখানে গাড়ী পার্কিং করা যাবে না (ঐ সময় রাস্তা পরিস্কার করা হয়) সেটাও লেখা রয়েছে।

মোদ্দকথা ‘শৃঙ্খলা’ ই মানুষকে সভ্য করে।

রাজধানী ঢাকার রাস্তার বর্তমান স্পীড নাকি এখন ঘন্টার ৩ কিলোমিটার এ এসে দাঁড়িয়েছে! ট্রাফিক আর ট্রাফিক। কোথাও কোন শৃঙ্খলা নেই, যে যেখান দিয়ে যার আগে পারছে চলে যাচ্ছে। পাবলিকের জন্য নির্ধারিত ফুটপাত দিয়ে অনায়াসে চলে যাচ্ছে মোটরসাইকেল।

চলন্ত গাড়ীর সামনে দিয়ে হঠাৎ চলে যাচ্ছে কেউ দৌড় দিয়ে অথবা উঠে আসছে রিক্সা উল্টো পথ দিয়ে- পুলিশকে সামান্য ২ টাকা ঘুষ দিয়ে।

কোথাও কোন শৃঙ্খলা নেই। পুলিশ নিজেই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ডিজিটাল সিগনাল ব্যহত করে।

এভাবে বিশৃঙ্খলাতেই ঢাকা শহর এখন স্থবির।

অথচ সামান্য শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা গেলে, কঠিন ও কঠোর ট্রাফিক আইন এবং তার বাস্তবায়ন করা হলে- ঢাকা শহরকেও শৃঙ্খলায় আনা সম্ভব।

উন্নত বিশ্বের সবচে ঘনবসতিপূর্ণ শহর নিউ ইয়র্ক যেখানে প্রতি বর্গমাইলে জনঘনত্ব ২৮,২১০ জন (টোকিওতে ১৬,১২১ জন)। আর প্রাণের শহর ঢাকাতে জনঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে দাড়িয়েছে এখন ৭৫,২৯০ জন।

কিন্তু ঢাকাতে গাড়ীর সংখ্যা নিউ ইয়র্ক বা টোকিওর মতো এত বেশী নয়।

রাস্তা কম, মানুষ বেশী এসব আসলে আইন অমান্য করার অযুহাত মাত্র। মানুষ বেশী বলে শৃঙ্খলা থাকবে না এটা অসুন্দর ও বামন চিন্তা।

ঢাকায় যতটুকু রাস্তা রয়েছে, যতটুকুই বা ফুটপাত রয়েছে শুধুমাত্র শৃঙ্খলা, কঠোর আইন বাস্তবায়ন করা গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, যাওয়া সম্ভব।

রাস্তায় কোন পুলিশের দরকার নেই।
রাস্তায় দাগ কেটে দিন, কোন লাইন দিয়ে কোন গাড়ী চলবে নির্ধারণ করে দিন, প্রতিটি সিগনালে অন্তত পক্ষে (ডিজিটাল সম্ভব না হলে) লাল সাইন দিয়ে ৩ সেকেন্ড বাধ্যতামূলক চলার আইন করুন, ফুটপাত শুধুমাত্র মানুষের হাঁটার জন্য নির্ধারণ করে দিন।

আর পুলিশের হাতে আইনী টিকেট দিয়ে দিন- যে যে আইন মানলো না তার তার বাড়ীতে ‘টিকেট’ পাঠিয়ে দিন। ঢাকার রাস্তা থেকে ৮ বছরের বেশী পুরাতন সব গাড়ী বিদেয় করে দিন।

তারপর দেখুন একটা শহর শৃঙ্খল হলে, একটা শহরের মানুষগুলি সব সুশৃঙ্খল হলে দেখতে কত সুন্দর লাগে।

সকলকে যখন আইন মানতে দেখা যাবে তখন দেখবেন ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও তখন সভ্য হতে লাইন দিয়ে দাঁড়াবে।

শক্তিশালী আইন, তার যথাযথ প্রয়োগই একটি সুশৃঙ্খল ও সভ্য জাতি তৈরী করতে পারে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *