লেপারাসকপি


শুয়ে বসে থাকতে কার ভালো লাগে?
 
আমি পারি না। কোনদিনই পারিনি।
দিনগুলি বরং ৭২ ঘন্টার রূপান্তর হলে আমার জন্য আরও ভালো হতো।
 
গত পরশু ‘মানডে’ এখানকার ডাক্তাররা আমার একমাত্র গলব্লাডার’টি লেকারাসকপি নামক এক সার্জারীর নামে- শরীর থেকে কেটে ফেলে দিলেন- ওখানে না কি ষ্টোন তৈরী হয়েছে।
 
ষ্টোন থাকলে আমার কোন সমস্যা ছিল না- কিন্তু ওটার অসহ্য ব্যাথা আমাকে অনেকদিন ভুগিয়েছে। ব্যাথার একটা স্কেল রয়েছে। সেই স্কেলে আমার ব্যাথা উঠেছিল ১০ এ ১০।
 
গলব্লাডারটি ফেলে দেবার জন্য আমার পেটে মোট ৪টি ছিদ্র করা হয়েছিল।
 
সকাল ৭টায় সেন্ট বার্নাবাস হসপিটালে পৌছলাম। পৌনে আটটায় ভেতরে ডেকে নিল। নয়টায় অপারেশন থিয়েটারে।
 
আমেরিকার মতো দেশে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই অভাবনীয় উন্নতির যুগে ‘লেকারাসকপি’ একটি অত্যন্ত সহজ সার্জারী। ঝুকি নেই বললেই চলে। তার উপর আমি সাহসী মানুষ। হাসতে হাসতে ওটিতে ঢুকলাম। ইটালিয়ান-আমেরিকান ডাক্তার ভেনসিস ততক্ষনে আমার খুব ঘনিষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়েছেন। ওটিতে ঢুকার আগেও ৩ বার আমার সংগে পার্সোনালী দেখা করে গেছেন- আমি ওনাকে বললাম, ‘তুমি তো জানি অভিজ্ঞ সার্জন, ভয় পাচ্ছো না কি- আমার সার্জারীতে?’
 
ভেনসিস আমাকে সাহস দেবেন কি নিজেই হেসে দিলেন।
 
ওটিতে ঢুকার পর তিনজন ডাক্তার আমার সংগে একে একে পরিচিত হলেন।
 
প্রথমে এলেন ডাক্তার শফিক। নিজের পরিচয় দিলেন এনেসতাশিয়ান। আমি তাকে বললাম, ‘তোমার বাড়ী তো মনে হচ্ছে ইন্ডিয়ায়- ঠিক বললাম কি?’
 
ভদ্রলোক হেসে দিলেন- ‘একদম ঠিক’।
 
ডাক্তার মুহাম্মদ হেসে হেসে হাত মেলালেন আর বললেন আমি কিন্তু ‘ইরানীয়ান আমেরিকান’। আমিও মৃদু হাসলাম।
 
আমেরিকানরা কাজে কর্মে খুব স্মার্ট হয়ে থাকে; মুহুর্তেই আমাকে রেডী করে ফেললো সবাই; অনেকটা যেন কোরবানীর ‘গরু জবাই’ দেয়ার প্রস্তুতি!
 
হাতে স্যালাইনও রেডী- আমি অপেক্ষা করছি কখন এনেসতাসিয়ার ইনজেকশন পুশ করা হবে! ওটি তে ঢুকার আগে একবার আইতুল কুরশি পড়েছি আর অবচেতন মনেই কি যেন কি মনে করে তওবা পড়ে কালেমাটা পড়ে ফেলেছি।
 
ডাক্তার ভেনসিস আবারও আমাকে বললেন, ‘হেই তৌফিকুল, তুমি কি সত্যিই রেডী? না কি ক্যানসেল করে দেব আজ?’।
 
আমি কৃত্রিম কষ্ট এনে বললাম, ‘তুমি কি সত্যিই বেশী ভয় পাচ্ছো? তাহলে বাদ দাও না! এতো ভয় নিয়ে কিভাবে ডাক্তার হয়েছো?’
দেখি সবাই হাসছে।
 
ভেনসিস বলল, ‌’ঠিক আছে সব খুলে ফেললাম কিন্তু!’
 
ঠিক তখনই একজন ব্লাক লেডী ডুকলেন। হাতে খাতা-পত্র।
আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নাম? জন্ম তারিখটা বলো।’
আমি বললাম।
 
‘তুমি কি জানো তোমাকে কেন এবং কি সার্জারী করা হবে?’
আমি উত্তর করলেম।
 
‘তোমার কোন আপত্তি নেই তো এই সার্জারীতে? থাকলে আমাকে নির্দিধায় বল।’
আমি বললেম, না কোন আপত্তি নেই।
 
‘লেকারাসকপি তে কোন সমস্যা হলে কিন্তু তোমাকে ওপেন সার্জারীতেও যাওয়া লাগতে পারে এবং এমনকি ব্লাডও লাগতে পারে- তুমি সম্পূর্ণটাতে সম্মতি দিচ্ছ?’
আমি সম্মতি দিলাম।
 
এবার ভদ্রমহিলা ডাক্তার ভেনসিস কে প্রশ্ন করলেন, ‘ডাক্তার ভেনসিস, তুমি কি সার্জারী টিমের প্রধান?’
ডাক্তার ভেনসিস হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেন।
 
‘তুমি কি তোমার টিম নিয়ে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তত একটা সফল সার্জারী করতে? তোমার প্রতিটি যন্ত্রপাতি ঠিক-ঠাক রয়েছে কি?’
এবারও ডাক্তার ভেনসিস হ্যা সূচক উত্তর দিলেন।
 
ভদ্রমহিলা টিমের প্রতিটি সদস্যের কাছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি একে একে দেখাতে বললেন- সবাই সব যন্ত্রপাতি দেখালেন ভদ্রমহিলাকে।
ভদ্রমহিলা একটা সফল সার্জারী এবং আমার শুভকামনা করে সার্জারী করার অনুমতি দিলেন। ও হ্যা; ভদ্রমহিলা সোসাল ওয়ার্কার। আমেরিকার হসপিটালগুলিতে সোসাল ওয়ার্কাদের কতৃর্ত্ব সবার উপরে- তারা রোগীর স্বার্থ দেখে থাকেন।
 
এবং ঠিক তখনই অনুভব করলাম ডাক্তার শফিক আমার হাতের স্যালাইন দিয়ে ইনজেকশন ঢুকাচ্ছেন; আমি আমার রগে এনেসতাশিয়া’র প্রবেশ অনুভব করলাম।
 
আমার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন লক্ষ্য করলাম একজন চাইনিজ নার্স আমাকে প্রশ্ন করছে ‘তুমি ঠিক আছো?’
 
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাকিয়ে শুধু বললাম, ‘সার্জারীর স্থানগুলিতে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছি’।
 
অন্য একজন ডাক্তার সামনে আসলেন; বললেন, ‘ফোর মিলিগ্রাম মরফিন ইনজেকশন দাও’।
 
নার্স মরফিন ইনজেকশন স্যালাইনে দিলো। ব্যাথা করার আগেই আমি আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম।
 
সম্ভবত আরও ঘন্টাখানেক পর ঘুম ভাংলো।
 
সেই নার্স আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ‘তুমি ঠিক আছো? ব্যাথা কমেছে? চলো তোমাকে নীচে নিয়ে যাই; সেখানে তোমাকে কিছু খাবার দেবো। তারপরই তোমাকে ডিসচার্জ করে দেবো। তুমি সম্পূর্ণ ওকে।’
নার্স আমাকে নীচ তলায় নিয়ে গেল। দু’টি ঠান্ডা জুস খেতে দিলো। আমি জুস শেষ করে ঠান্ডা পানি খেতে চাইলাম; বরফ-পানি চলে আসলো; খেলাম।
 
তারপর আবারও ঘন্টাখানেক ঘুম।
তারপর ডিসচার্জ পেপারে সিগনেচার করে বাসায় ফেরা।
 
গতকাল ডাক্তার ভিনসেস ফোন করে খবর নিলেন; টুকটাক কিছু প্রশ্ন করে বললেন, ‘ইও আর পার্ফেক্ট; কাল ড্রেসিং করে গোসল করে ফেলো। আর থার্সডে-তে ঠিক ১টায় আমার সংগে দেখা করবে।’
 
পেটে ব্যাথা নিয়ে দু’দিন যাবৎ বাসায় শুয়ে রয়েছি সংগে পেইন মেডিকেশন নিচ্ছি।
 
দিনগুলি ৭২ ঘন্টায় হলে কষ্টটা মনে হয় বেশীই হতো।
থাক ২৪ ঘন্টাই ভালো।
 
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *