বাংলা দেশপ্রেম


’আপনি যেভাবে স্ট্যাটাস দেন- তাতে অনেকেরই গায়ে লাগে। এতে তো আপনার ফলোয়ার কমে যাবে!’
’আপনি সবসময় বাংলাদেশকে ছোট করে পোস্ট করেন।’
’কথার ছলে বাংগালীদের গালি দেয়া আপনার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে।‘ 
 
এ জাতীয় কমেন্ট মাঝে মধ্যেই পাই। বিরূপ সমালোচনা আমি পছন্দ করি। এবং তার উত্তর দেয়াটাকেও ফরজ মনে করে। তাই বলে প্রতিটি কমেন্টের পিছু পিছু উত্তর দেবার মতো সময়, আগ্রহ বা ধৈর্য্য আমার থাকে না। হয়তো অনেকেরেই থাকে না। 
 
 
আমি যে-কোন বিষয়ে লিখতে গেলে আগে সেটা চতুর্মূখী পর্যবেক্ষন করি এবং বোঝার চেষ্টা করি সমস্যাটার উৎপত্তি কোথায়। এবং সমাধানের সম্ভাব্য পথগুলি বের করার চেষ্টা করে লেখা বা আর্টিকেলটি শেষ করি।
 
আর এতে, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের ঘারেই শেষ পর্যন্ত দোষটি গিয়ে বর্তায়।
 
এবং, অনেকেই ধারণা করে বসে যে – আমি না কি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লিখি।
 
আমার লেখা যারা নিয়মিত পড়েন, তারা বেশ ভালোই জানেন যে আমি কাউকে খুশী করার জন্য কিছুই লিখি না। আমি তোষামোদী করতে জানি না বা পরি না। স্ট্রেইট কথা বলি। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলাটা আমার জন্মগত স্বভাব। আমার জীবনে ভুলেও কোনদিন কাউকে তেল মেরেছি – এমন উদাহরণ কেউ দিতে পারবে না। আমি আমার স্ট্যাইলে কথা বলি। যুক্তি, যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ করে তথ্য উপস্থাপন করি। এবং আমি ক্যালকুলাসের গতিতে লজিক দিয়ে চিন্তা করতে জানি। 
 
সম্ভবত এখানেই আমার স্বাতন্ত্র। আমি নিজস্বতা এনজয় করি। এবং আমি গণমানুষের পক্ষে কথা বলে আনন্দ পাই। গণমানুষের স্বার্থে কথা বলি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এরা সেই গণমানুষ – যারা নিজেদের স্বার্থটুকুও ঠিক-ঠাক ক্যালকুলেশন করতে শিখে নাই। এবং এটাই প্রধানতম সমস্যা। একমাত্র সমস্যা। 
 
আর যখনই আমি ‘গণমানুষের বৃহত্তর স্বার্থ’ নিয়ে কথা বলি তখন তাদের ত্রুটিগুলোও আমার চোখে ভেসে উঠে। অর্থাৎ আমি আপনার দোষটুকু তুলে ধরে আপনাকে সংশোধন হতে বলি। দোষ পেলে আমি নিজেই আগে নিজেকে সংশোধন করে ফেলি। আর আগেও বলেছি, ‘আপনি যদি আপনার নিজের দোষটুকুই না জানেন তাহলে নিজেকে শোধনাবের কিভাবে? জানতে তো হবে যে আপনার দোষটা ঠিক কি?’
 
আমি বাংলাদেশের দোষগুলি খুঁজে বের করি।
সেখানে আমি আমার নিজের, আমার পরিবারের, আমার কালচারের, আমাদের দেশের সংবিধানের, আমার দেশের মানুষের সমস্যাগুলি চিহ্নিত করি।
 
এবং সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথ দেখাই।
 
এবং এটাকে যখন কেউ বলে আমি দেশের বিরুদ্ধে লিখি- তখন আমি হাসি।
বং তার চিন্তার দৈনতায় কষ্ট পাই।
তার আত্ম-অহমিকায় ভীত হই।
দেশের ভবিষৎ নিয়ে আরও শংকিত হই।
 
একটা সামান্য বিষয়ও আমরা ঘোলা করে ফেলি যে, ‘আমিই দেশকে সবচে বেশী ভালবাসি।’
 
আবার কেউ কেউ দাবী করে বসে ‘তারা নিজেরাই শুধুমাত্র দেশকে ভালবাসে’ বাদবাকীরা নাকি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি! অমুকের দালাল। ইত্যাদি।
 
কতটা নির্লজ্জ এবং মূর্খ হলে এসব ফালতু কথা গলা বাড়িয়ে বলতে পারে মানুষ!
 
এদেশে জন্ম নেয়া, এবং এদেশের মাটিতে, আলো-বাসাতে বেড়ে উঠা প্রতিটি মানুষই তার নিজ মাতৃভূমিকে সম-ভাবে ভালোবাসে যদিও প্রত্যেকের প্রকাশ ভংগি ভিন্ন হতে পারে; হয়; হওয়াটাই স্বাভাবিক। সকলে একভাবে চিন্তা করতে পারে না, করে না।
 
আমি আমার লেখায় অনেক সময় বাংলাদেশকে খোঁচা দিই। 
কেন দিই? ভেবেছেন কখনও? আপনি ভাবেন – আপনি একাই দেশকে ভালো বাসেন; অন্য বা আমি বাসি না। তাই তো?
 
আপনি দেশকে কিভাবে ভালো বাসেন – একটু বলবেন? কিভাবে কিভাবে দেশকে ভালো বাসতে হয়?
দেখি তো বলতে পারেন কি না? আপনি বলতে পারবেন না- কারণ আপনি তা জানেনই না। 
 
আপনি দেশে বসবাস করেন (আমি নিজেও টানা প্রায় ৪০ বছর দেশে বসবাস করেছি)। আপনার চারপাশের পরিবেশ, কার্যক্রম আপনি সবই বুঝেন, জানেন। 
 
একটা প্রশ্নের উত্তর কি কখনও খুঁজেছেন যে ‘দেশকে কিভাবে ভালবাসতে হয়?’
 
প্রফাইলে নিজের ছবিতে সবুজ লাল রং লাগালেই দেশপ্রেম হয়ে যায়?
জনগণের কষ্টের ট্যাক্সের ১০০ কোটি টাকা খরচ করে জাতীয় সংগীত গাইলেই কি দেশপ্রেম হয়ে যায়?
১৬ই ডিসেম্বর একযোগে টাইমলাইনে জাতীয় পতাকা টাংগালেই দেশপ্রেমের রেকর্ড হয়ে যায়?
২১শে ফেব্রুয়ারী ল্যাংটা পায়ে শহীদ মিনারে দাড়ালেই দেশপ্রেম হয়ে যায়!
 
‘দেশপ্রেম’ শব্দটিকে আপনারা যে ‘অতি সস্তা বাজারে শব্দ’ বানিয়ে ফেলেছেন! সেটা কি বুঝেন?
 
এই পৃথিবীর আর কোন দেশ বা জাতি রয়েছে যে এসব ফালতু, অপ্রয়োজনীয়, অলস এবং গুরুত্বহীন ‘প্রচার’ চালিয়ে তথাকথিত ‘দেশপ্রেম’ প্রদর্শন করে!
 
এসব দেশপ্রেমের নামে নোংরামো আদতে দেশকে ’ইভটিজিং’ করারই শামিল।
এসব করে দেশের ঠিক কি উন্নতি হয় – বলতে পারবেন?
 
এসব করে দেশের গরীব আয়-সহায়-সম্বলহীন ৭০% মানুষের জন্য কি একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন?
নাকি তাদের ‘হক’ এর টাকাটাকে নিজেদের নষ্টামীতে নষ্ট করে দেশকে ভালবাসা নয় বরং ধর্ষনের তৃপ্তি নিয়েছেন!
 
আচ্ছা আপনি যদি প্রতিদিন বাসায় গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার সদাই করার পরিবর্তে পরিবারের সকলকে ভালো-ভালো গান, লাল নীল সবুজ পতাকা আর তোমাদের ভালবাসি ভালিবাসি করে চিৎকার করতে থাকেন কিন্তু তাদের খাবারের, জামা-কাপড়ের, প্রয়োজনের সময় চিকিৎসার ব্যবস্থা না করেন- তাহলে তারা আপনার এই ‘ভালবাসা’ ‘পরিবারপ্রেম’কে লাথ্থি মেরে বের করে দিতে কয়দিন সময় নিবে বলতে পারেন?
 
যেটা আপনি পরিবারের সংগে করেন না সেটা ঠিকই দেশের সংগে করে যাচ্ছেন! এটাই তো আপনার দেশপ্রেম!
 
না। আমি এভাবে দেশকে ভালবাসি না।
তাই তো দেশপ্রেম দেখানোর কোন প্রয়োজনও কোনদিন প্রকাশ করিনি, করবোও না।
 
আপনাদের এতো এতো দেশপ্রেমের ফলেই তো আজ বাংলাদেশ একটা ’ডাষ্টবিনে’ পরিণত হয়ে রয়েছে- এখান থেকে কেউ বের করারও চেষ্টা করছে না।
 
আর আমি যখন একটু খোঁচা দিই, ধরিয়ে দিই- তখনই আমার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন করেন!
 
আমি পরোয়া করি না- সেটা কিন্তু বুঝে গেছেন।
করবোও না কোনদিন- নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
 
দেশকে ভালবাসতে হলে দেশের জন্য আলাদাভাবে কিছুই করতে হয় না।
 
শুধুমাত্র একটু সৎ থাকুন, কর্মঠ হোন, কাজ করুন। পরিশ্রম করুন, আয় করুন। দেশকে ভালো-যোগ্য-সৎ-মেধাবী, দূরদর্শী নেতৃত্বের হাতে অর্পনে কাজ করুন। দেশের সকল মানুষ কিভাবে তাদের সম্মিলিত আয় বাড়াবে সেদিকে নজর দিন।
 
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যখন বছরে মাত্র ১২ লাখ টাকা আয় করতে পারবে সেদিনই দেশ উন্নত হবে, দেশপ্রেম সফল হবে। মানুষের আয় বাড়ানোর কোন পরিকল্পনা নেই, দেশের ইনফষ্ট্রাকটারে কোন ডেভেলপমেন্ট নেই, সুশাসন নেই, বিচার বিভাগ ধ্বংশপ্রাপ্ত; সরকার নিজেই পাবলিক মানি লুটপাটে ব্যস্ত, পুলিশ সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত- আপনি ঘুমাচ্ছেন আর ছবি সবুজ লাল কালারে রাঙিয়ে দেশপ্রেম দেখাচ্ছেন!
 
যত্তসব ফালতু কাজকর্ম।
 
আমার একজন ফলোয়ার গতকাল ফোন করলেন জার্মানী থেকে- তিনি একটা চমৎকার কথা বললেন, ‘আমাদের দেশে একজন লেখকও নেই- যে কিনা তার নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে গিয়ে একটি লাইনও লিখতে পারে! সবকিছুতেই তারা সর্বাগ্রে নিজের লাভ, নিজের স্বার্থ ভেবে তারপর আর্টিকেল লিখে!’
 
ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য হলেও নিজের পক্ষে লিখতে হয়, মানুষকে তৃপ্ত করার জন্য ভালো ভালো লাইন লিখতে হয়- কিন্তু আমি তা করি না; আমার রুচি আসে না।
 
তবে আমার ফলোয়ারদের অনেক কিছু ভেবে চিন্তে আমাকে ফলো করতে হয়। আমার একটা লেখায় লাইক করতেও ভাবতে হয় অনেক কিছু। আমার এমন কিছু পরিচিত ঘনিষ্ঠ মানুষ রয়েছে যারা ‘ভয়ে’ আমাকে আনফ্রেন্ড তো করেছেই- কেউ কেউ ব্লকও করে দিয়েছে!
 
আমি সত্যিই ফলোয়ার নিয়ে ভাবি না।
আমার সংগে কিছু সাহসী মানুষ রয়েছে- এদের আরও সাহস বৃদ্ধি ও কিছু দিক নির্দেশনা দিতে সামান্য কিছু লেখার চেষ্টা করি।
 
করে যাবো।
যতটুকু-ই পারি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *