রুচি বোধ


মাথার চুল একটু বড় হলেই আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়- কবে চুল ছোট করাব।
 
আজ আবার গেলাম আমার সেই নাপিতের কাছে যে কিনা রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স করে ডিভি লটারী জিতে এখন নিউ ইয়র্কে ‘বারবার’ হিসাবে ক্যারিয়ার বেছে নিয়েছে। আগেই বলেছি সে চুল খুব একটা ভাল কাটে না কিনতু খুব যত্ন নিয়ে, সুন্দর ব্যবহার দিয়ে আমাকে মুগ্ধ রাখে।
 
কিছু অজানা তথ্য আজ তার কাছ থেকে জানলাম।
আমি এতো দিনে বুঝে গেছি যে, আমেরিকা এমন একটি দেশ- যেখানে সম্ভবত একটি পাখিও আকাশে উড়ার আগে- শৃঙ্খলা ভংগ হলো কিনা সে বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ থাকে! আমেরিকায় কোন কাক দেখা যায় না (ময়লা নেই- কাক কোত্থেকে আসবে!); রিমোট এরিয়ায় কখনো-সখনো একটা দুইটা ওয়াইল্ড এনিমেল (কুমির, সাপ, চিতাবাঘ ইত্যাদি) হয়তো বা ভুল করে আইন ভেংগে লোকালয়ে চলে আসে!! এই যা অনিয়ন্ত্রিত!!!
যাক এসব কথা।
 
এই নাপতি ভাইটি- নাপিতের কাজের জন্য নিউ ইয়র্ক সিটির একটা নাপিতের স্কুলে ১ বছরের একটি ট্রেনিং সম্প্ন্ন করে, সার্টিফিকেট নিয়ে তারপর নাপিতের কাজ শুরু করেছে। তার সার্টিফিকেটটি আবার ‘মাষ্টার সার্টিফিকেট’; মানে সে একাধারে নিজে যেমন দোকানে নাপিতের কাজ করতে পারবে আবার সেই সংগে এসিসটেন্টও রাখতে পারবে- কাজ শিখানোর বা প্রশিক্ষণ দেবার জন্য।
 
নিউ ইয়র্ক তথা সমগ্র আমেরিকায় সিষ্টেম বা নিয়মের বাইরে আমি আজ অবধি কোন কিছু পাই নাই। আজ জানলাম নাপিতের বিষয়টিও।
 
আগেই জেনেছি এদেশে প্রতিটি রেষ্টুরেন্টেই ন্যূণতম একজন ‘ফুড লাইসেন্স’ সম্পন্ন সেলস পারসন থাকতে হবে এবং এই ফুড লাইসেন্সটি প্রয়োজনীয় ট্রেনিং শেষে প্রদান করে নিউ ইয়র্ক ফুড ডিপার্টমেন্ট। নইলে রেষ্টুরেন্টের খবর আছে। এছাড়া প্রতিটি রেষ্টুরেন্টে- সিটি কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ভিজিট করে রেষ্টুরেন্টের সমগ্র ব্যবস্থাপনা ও খাবারের মান দেখে মূল দরজার সামনে বড় করে একটি ষ্টিকার ‘A’, ‘B’ অথবা ‘C’ ইত্যাদি ক্যাটাগরীর নাম্বার দিয়ে লাগিয়ে দেন। ‘বি’ বা ‘সি’ হলে জরিমানা তো রয়েছেই। মজার বিষয় হলো বাংলাদেশী মালিকানাধীন প্রায় সব রেষ্টুরেন্টের ক্যাটাগরীই সি-গ্রেডের! কাষ্টমার ঢুকার মুহুর্তেই অতি সহজে বুঝতে পারে এই রেষ্টুরেন্ট কোন গ্রেডের।
 
এদেশের প্রতিটি ফার্মেসীতে একজন সাটিফাইড ‘ফার্মাসিষ্ট’ থাকতেই হবে; নইলে ওষুধের দোকানও খুলা যাবে না।
 
এদেশের আরেকটি নিয়ম হলো- সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যার পর যার যার বাড়ীর সামনে পলেথিন প্যাকেটে মুখ ভালভাবে আটকিয়ে ময়লা রেখে দেয়া যাবে- সিটির গাড়ী এসে ময়লা নিয়ে যাবে। নির্ধারিত দিন বা সময়ের আগে ‘একাজ’ করলে খবর আছে।
 
আমেরিকার কোন বাড়ীতেই ছাদ নেই।
বাড়ীর বাইরে কাপড় শুকানোর জন্য ভেজা কাপড় কোথায় মেলা যাবে না, সিটির সৌন্দর্য ঠিক রাখতে হবে।
 
প্রতিটি বাড়ীর সামনে জমা ‘স্নো’ বা যে-কোন ময়লা বাড়ীওয়ালাকে নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করতে হবে। এদেশে তো কাজের লোক নাই- কাজেই বাড়ীওয়ালা ‘ভদ্রলোক’কে স্বপরিবারে নিজ বাড়ী পরিষ্কার করতে দেখা নিয়মিত ঘটনা।
 
আসলে এ এক অন্য পৃথিবী। আমার ভালই লাগে।
এখানে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে এবং জনবহুল এলাকায় এক বা একাধিক প্লাষ্টিকের ডাষ্টবিন বসানো থাকে। সেটা কোন বিষয় না। বিষয় হলো ডাষ্টবিনের ভেতরে বড় প্লাষ্টিক ব্যাগ দেয়া থাকে; ময়লা জমা হলে নির্ধারিত সময় সিটির লোক এসে ভড়া প্লাষ্টিকটি নিয়ে যায় এবং নতুন আরেকটি খালি প্লাষ্টিক বসিয়ে দিয়ে যায়। ডাষ্টবিন কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে পারে না- এমনভাবে বসানো থাকে; যদিও এদেশে বাংলাদেশের মতো কোন ডাষ্টবিন চোর নেই।
 
অপরদিকে মানুষ তাদের নিজ নিজ বাড়ীতেও ডাষ্টবিনের উপর একটা প্লাস্টিক ব্যাগ রেখে দেয় এবং ময়লাগুলি ওই প্লাষ্টিকের ভেতরেই ফেলে; পরবর্তীতে শুধু প্লাষ্টিক ব্যাগটির মুখ আটকিয়ে সময়মত ফেলে দিলেই হলো।
 
বাংলাদেশে তো প্লাষ্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ; তাই বাংলাদেশের মানুষ সরাসরি ডাষ্টবিনেই ময়লা জমায় এবং ময়লাওয়ালা এসে তার ময়লা হাতে অতি দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা নিয়ে যায় এবং বাসার কাজের মেয়েটি সেই খালি ময়লার বালতি বা ডাষ্টবিন বাথরুমে নিয়ে পরিস্কার করে প্রতিদিন। পুরো বাসা ময়লার দুর্গন্ধে ভরে যায়।
 
বাংলাদেশ এখনো প্লাষ্টিকের ব্যবহারও শিখলো না!
পরিবেশের ‘প’টাও বুঝে না এমন ‘জ্ঞানী পরিবেশবাদী’দের চেচামেচি আর অশিক্ষিত সরকার ও গাধা আমলারা বাংলাদেশে প্লাষ্টিক বন্ধ করে দিয়েছে পরিবেশ দুষণের কথা বলে।
 
আর একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে মন চাচ্ছে।
 
আমি ১৯৯৬ সালে জীবনে প্রথমবার চট্রগ্রামের ‘ফয়েস লেক’ দেখতে যাই। ফয়েস লেক যে কতটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরা একটা লেক- ওই সময়ের আগে যে নিজ চোখে তা না দেখেছে সে বুঝতেও পারবে না। আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম; প্রায় ঘন্টা তিনেক সময় নিয়ে বসে ছিলাম ফয়েস লেকের সৌন্দর্য্য দেখতে। প্রচুর ছবি তুলেছিলাম সেদিন।
 
পরিস্কার নীল জলে ভরা একটি লেক আর অগোছালো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ী দ্বীপ। প্রকৃতির এক অদ্ভুৎ খেয়ালে তৈরী যেন ওই ফয়েস লেক। গাঢ় সবুজ ঘাসে ঢাকা সেই পাহাড়গুলি পানির উপর কি-যে এক সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করেছে ভাবা যায় না। আমার জীবনে দেখা সবচে চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তালিকায় ফয়েস লেক-কে নাম্বার-ওয়ানেই রাখতাম।
 
পরবর্তীতে আমি বিশ্বের অনেক অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান ভ্রমণ করেছি কিনতু ফয়েস লেকের অবস্থানকে নীচে নামাতে পারিনি। চীনের কুনমিং এর কাছের ‘ষ্টোন ফরেষ্ট’, সিকিমের গ্যাংটকের কাছে ‘সংগু লেক’ও আমি দেখেছি।
 
কিনতু সম্ভবত ২০০০ সালের দিকে আমি আমার কয়েক বন্ধুকে নিয়ে আবার যাই তাদের ফয়েস লেকের সৌন্দর্য্য দেখাবো বলে।
 
এবার টিকেট কাটতে হলো। ভেতরে গেলাম।
কিনতু আমার দেখা সেই ‘ফয়েস লেক’ কোথায়? ফয়েস লেক কি হারিয়ে গেল? না কি আমি ভুল জায়গায় আসলাম? সত্যি আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে ঠিক কোথায় আসলাম।
 
অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলাম বিষয়টি।
আমাদের দেশের অতি বুদ্ধিমান, জ্ঞানী আর পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিদের বুদ্ধিমত্তায় এবং অসম্ভব দক্ষতায় ফয়েস লেকের সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ী দ্বীপগুলিতে বড় বড় বৃক্ষরোপন করা হয়েছে। আর সেই বৃক্ষের আড়ালে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে সেই ফয়েস লেক ও তার সেই সৌন্দর্য্য।
এজন্য কারো কোন দুঃখবোধও কোনদিন শুনিনি।
 
বাংলাদেশের কোন রুচিও নেই! পরিকল্পনা তো নেই-ই!!!
সত্যি খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।
 
আমেরিকায় অপরিকল্পিত কোন কিছু নেই, আমি দেখিনি। যেখানে যেটা দরকার, যেখানে যেই আইন দরকার, যেখানো যে বিষয়টা দরকার তার সবই ঠিকঠাক মতোই আছে এদেশে।
 
,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *