মিশন ওজন কমানো


২০০৮। কলিকাতা সাবওয়ে মেট্রো ষ্টেশন চাঁদনী চক।রবিন্দ্র সদন যাবো। ট্রেন আসতে তখনও প্রায় ৭ মিনিট বাকী। হঠাৎই চোখের সামনে দেখতে পেলাম একটি ওজন মাপার যন্ত্র। ২টি কয়েন ফেলতে হবে। পকেটে ছিল, ফেললাম।
আমার চক্ষু চরকগাছ হয়ে গেল।এটা কিভাবে সম্ভব। নির্ঘাৎ মেশিন নষ্ট। আমি বিগত প্রায় ১০ বছর যাবত অনিয়মিতভাবে আমার ওয়েট মেপে আসছিলাম সবসময়ই সেটা ৭২ কেজি দেখাতো। একটু আগেই লাঞ্চ করেছি- সেই হিসাবে ১ বা দুই কেজি বেশী হতে পারে; কিন্তু তাই বলে ৮৩ কেজি?
না না না। মানি না। অসম্ভব। মেট্রোর মেশিন নষ্ট।অন্য একটি মেশিন দেখতে পেলাম, সেটায় গেলাম। আবার ২টি কয়েন ফেললাম। কলিকাতায় গেলে পকেটে অনেক কয়েন জমা হয়। আমি প্রায়ই রাস্তায় ফুটপাতের খুব ঠান্ডা সোডা-শরবত খাই, বেলের শরবত খাই, লাচ্ছি খাই আর পকেটে কয়েন জমা হয়। বাদ দেই না কাঁচা পেয়াজ কুচি দিয়ে বানানো সাতুর শরবতও।
কিন্তু আমার চিন্তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে এই মেশিনটিও আমাকে ৮৩ বলে সার্টিফিকেট দিয়ে দিল। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে হচ্ছিল মেশিন ভেংগে ফেলি। এটা কিভাবে সম্ভব।
তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, ১২ কেজি ওয়েট কমিয়ে ফেলবো; যে-কোন মূল্যে।
কিন্তু কিভাবে? তাও বুঝতে পারছি না।
রবিন্দ্র সদনের কাজ শেষ হলে এবার ফিরতি সাবওয়ে ট্রেনে পার্ক ষ্টিট ধরবো। ঠিক তখনই কলিকাতা ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর মজুমদার আমাকে ফোন করলেন।
পুলিশ ইন্সপেক্টর মুজমদার আমার খুবই ভালো বন্ধু। প্রায়ই আমরা সন্ধার আড্ডা দেই। ফোন করেই বলল আজ সন্ধ্যায় কলিকাতা ক্লাবে আসতে পারবো কি না? মজুমদার জানে যে আমি কখনওই না বলবো না।
সন্ধ্যায় কলিকাতা ক্লাবে ঢুকলাম।ইন্সপেক্টর মজুমদার আমার আগেই পৌছে গেছে। তার সংগে আরও একজন ভদ্রলোক বসা। বেশ স্বাস্থ্যবান। আমার সঙগে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য নিয়ে এসেছে। তিনি ডাক্তার রাজকুমার রায় চৌধুরী, চিকিৎসক।
খাওয়া দাওয়া চলছে। আমরা আড্ডা দিচ্ছি। আমি একটু আগ বাড়িয়ে ডা. রায় চৌধুরীকে আমার আজকের কাহিনী বললাম। তাকে জানালাম, ‘আমার ওজন কমাতে হবে। আপনি পারবেন কি না?’
ডা. রাজকুমার রায় চৌধুরী আগামীকাল আমার হোটেলে আসবেন, আমার চিকিৎসা ফাইল দেখে সিদ্ধান্ত জানাতে। তার ভিজিট ৫০০ রুপি।
আসলেন পরের দিন। সব দেখলেন। প্রেসার দেখলেন। ডায়াবেটিস তখনও নেই। আমার খাবার হজমের সমস্যা ছিল, স্টমাক অনেক সময় নিতো খাবার হজম করতে। তখন আমি সবে মাত্র লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. কাভিটা মিশ্রা’র দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রেসার ও ঘুমের ওষুধ খাচ্ছি। তিনি আমাকে নতুন প্রেসক্রিপশন করে দিলেন। ২ মাসের কোর্স। আমার ওজন ১২ কেজি কমে যাবে।
পরদিন সকালে নিউ মার্কেট থেকে ২৪ হাজার রুপির ওষুধ নিলাম। ব্যস, পরম উৎসাহে নিয়ম মেনে খেতে শুরু করলাম। প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করলাম প্রচুর ওয়েল যাচ্ছে শরীর থেকে। বুঝলাম কাজ হচ্ছে। হজম শক্তি ১০০% বেড়ে গেছে। খাবার খাওয়ার ১ ঘন্টার মধ্যেই হজম হয়ে যাচ্ছে।
আহ, কি শান্তি! কি আরাম।বুঝতে পারছিলাম দ্রুত ওজন হারাচ্ছি। এবং হ্যা, মাত্র ২ মাসের মধ্যে আমি সত্যি সত্যিই ১২ কেজি ওজন হারিয়ে আবার সেই ৭১/৭২ কেজিতে ফিরে আসলাম।
তারপর আবারও দীর্ঘ ১০ বছর সেই একই ওজন ধরে রাখছিলাম।আমি অল্প খাবার খাই। দিনে মাত্র দুই বেলা। সকালে হাবিজাবি আর সন্ধ্যায় ভাত খাই, সংগে বেশীরভাগ সময় মাছ ও সবজী খাই। মাংস মাসে হয়তো এক-২দিন খাওয়া হয়- তাও যদি সেটা হয় দেশী মুরগী (অর্গানিক চিকেন)র মাংস। আর শসা।
আমি নিজে নিজেই আমার ওজন অনুমান করি।আমি কিছু বিষয় সুন্দর অনুমান করতে পারি। যেমন আমার বা অন্য যে-করো কপালে হাত দিয়ে ও নাকের নিশ্বাসের অনুভূতি নিয়ে শরীরের তাপমাত্রা থার্মোমিটার ছাড়াই আমি একিউরেট বলে দিতে পারি। আমার সুগার লেভেল অনুমান করতে পারি। আমার প্রেসারও অনুমান করতে পারি- কত চলছে? যন্ত্রপাতি লাগে না। আর এখন ওজনটাও বুঝি- না মেপেই।
তো, এই পরিমিত খাবারের মধ্যেও মাঝে-মধ্যে খাবারের পরিমান সচেতনভাবেই একটু বাড়িয়ে দিই।
এভাবে কিছুদিন পর যখন বুঝি ওয়েট বেড়ে গেছে- আবার খাওয়া কমাই। এতেই বেশ কাজ হয়। আমি নিয়মিত গ্রীন টি খাই। মধু খাই। কিসমিস খাই। ঢেরশ খাই, মিষ্টি আলূ খাই, তেতুল খাই। এবং ইওগট (টক দই) খাই।
যাই হোক, এভাবেই চলছিল।
২০২০। নিউ ইয়র্ককিন্তু অতি সম্প্রতি আবার লক্ষ্য করলাম, পেনডামিক এর কারণে আমার ওয়েট আবারও অনেক বেড়ে গেছে।
গত ৪ সপ্তাহ আগে সিদ্ধান্ত নিলাম ৩০ পাউন্ড ওয়েট ঝেরে ফেলবো।
আমি আবার যা বলি সেটাই করি। মুখের কথাই সব। বলতে পারলে করতে পারবো; যেটা বাস্তবায়ন করতে পারবো না সেটা বলতেও পারবো না।
এবার অবশ্য ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে এবং আমাজন রিভিও দেখে একটা ওষুধ এর সহায়তা নিলাম। ৪ মাসের কোর্স। এটা কিটোফিট এডভান্সড ফর্মূলা। দিনে ২টা খেতে হবে, ৪ মাস খেতে হবে। আমার প্রাইমেরী কেয়ার ফিজিসিয়ান ডা. ইমরান ভাইকে ফোন করে জানতে চাইলাম কোন সমস্যা হবে কি না? তিনি জানালেন খেয়ে দেখেন, অসুবিধা হলে খাবেন না এবং আমাকে জানাবেন।
ব্যস। শুরু হয়ে গেলে মিশন ওজন কমানো।এবারের প্রজেক্ট ৩০ পাউন্ড মানে সোজা বাংলায় সাড়ে ১৩ কেজি ওজন কমাবো। যা থাকে কপালে। আর প্রতিদিন হিসাব মিলিয়ে ৮৫০০ ষ্টেপস হাঁটা তো চলবেই।
১৭৫ পাউন্ড বা ৮০ কেজি থেকে নীচে নামতে হবে। সেটাকে নামাবো ১৩ কেজি নামিয়ে ৬৭ কেজি বা ১৪৫ পাউন্ডে।
দ্বিতীয় সপ্তাহেই প্রায় ৫ পাউন্ড কমে গেলাম। গেল সপ্তাহে আরও সাড়ে চার পাউন্ড; আজ মাত্রই ওজন মেপে আসলাম; কমেছে আরও সাড়ে ৩ পাউন্ড।
আমার ডাক্তার তো অবাক।কিভাবে করলেন? বললাম, ‘ফি দিলে বলতে পারি; আমেরিকায় কোন কিছু ফ্রি পাওয়া যায় না’।
ভাবছি এই হারে কমতে থাকলে আগামী ৫৮ সপ্তাহ বা ১ বছর পর তো আমি আর এই পৃথিবীতে থাকবোই না। হাওয়ার সংগে মিলিয়ে যাবো। আমার ওয়েট জিরোতে নেমে আসবে!
আরও ১২ সপ্তাহ পর কোর্স ব্রেক না দিয়ে চালাবো নাকি টানা ৫৮ সপ্তাহ?
খুব মজা হবে। হয়তো তখন দেখা যাবে বাতাসে ভাসতে ভাসতে ঢাকার মিরপুরেই চলে এসেছি; বা প্রিয় গ্রীন রোডে কিংম্বা দোহারে। হয়তো বা অন্য কোন জেলায়- হতে পারে সেটা সিলেট, চট্রগ্রাম বা নরসিংদী’র গাবতলিতেই!
তখন তো ঢাকার মেট্রোরেল থাকবে তাই না?বা, পদ্মার উপর সেতু!