বামন-দেশ!


বিষয়টা বেশ মজার।
বেশ কয়েক বছর হলো ‘গ্রহ প্লোটো’কে ‘বামন গ্রহ’ হিসাবে অবনমিত করা হয়েছে।
 
সারা পৃথিবীর জোতির্বিজ্ঞানীরা বসে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এখন থেকে প্লোটো’কে আর গ্রহ বলা যাবে না। প্লোটো’র ততটুকু যোগ্যতা বা স্ট্যান্ডার্ড নেই যতটুকু থাকলে তাকে গ্রহ বলা যেতে পারে।
 
ব্যস। আর যায় কোথায়?
প্লোটো হয়ে গেল ‘বামন গ্রহ’।
 
দেশে থাকতে টবে চাষ করা গাছপালার প্রতি আমার বেশ আগ্রহ ছিল।
অনেকগুলি ‘টব’ ছিল আমার। তারমধ্যে একটা চমৎকার ‘বাঁশঝার’ও ছিল। ওগুলিও ‘বামন বাঁশ’। খুব মজা পেতাম ওগুলি দেখে।
 
ব্রুকলীনের বোটানিকেল গার্ডেনে একটা ‘বড়সর শিতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ঘর’ই রয়েছে (ট্রপিক্যাল প্যাভেলিয়ন) যেখানে দেখা মিলে হরেক রকমের ‘বামন গাছ-পালা’রও। অতিকায় বটগাছেরও বামন সংস্কারণ দেখা মিলে ওখানে।
 
আমি কৌতহলী মানুষ।
এসবে খুব মজা পাই। দেখি। চোখ আর মন ভরে দেখি।
 
মানুষের মধ্যেও রয়েছে ‘বামন মানুষ’।
ছোট বেলায় দেখেছিও, ওদের বলা হতো ‘বামনবীর’।
 
ওদের জন্য আমার ভীষন মায়া হতো।
সিনেমায়ও দেখা যেত বামনদের। এছাড়া কিছু শপিং মলেও ঢাকাতে দেখতাম বামনদের কাজ করতে।
 
আসলে ‘বামন’ সেটাই- যারা সবকিছু থাকা সত্বেও পরিপূর্ণ ‘স্ট্যান্ডার্ড’ মেনটেইন করতে পারে না।
 
আর তখনই ‘প্লোটো’র মতো গ্রহকেও হয়ে যেতে হয় ‘বামন গ্রহ’।
আসলে মূল বিষয়টাই হলো স্ট্যান্ডার্ড।
 
এই যে আমরা কমপিউটারে টাইপ করি, ইন্টারনেট চালাই, কেউ কেউ পোগ্রাম লিখি- এই কমপিউটার মাত্র দু’টি ভাষা বুঝে একটা হলো ১ এবং অপরটি হলো ০। এটা বাইনারী স্ট্যান্ডার্ড। শুধুই এই ১ এবং ০ দিয়েই আজ বিশাল এক ডিজিটাল জগত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
 
আবার যখন এই ১ এবং ০ দিয়ে ২৫৬টি ক্যারেক্টার তৈরী করা হলো সেটাও একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরী হয়ে গেল যেটাকে সংক্ষেপে বলা হয়ে ‘এসকি কোড’ American Standard Code for Information Interchange বা ASCII যেখানে রয়েছে ১২৮টি ইউনিক ক্যারেক্টার দিয়ে মোট ২৫৬টি ক্যারেক্টারমালা।
 
সবকিছুরই রয়েছে একটা স্ট্যান্ডার্ড।
 
ঠিক তেমনি একটা দেশ তৈরী করতে হলেও কিছু স্ট্যান্ডার্ড থাকতে হয়।
 
সৌন্দর্য্যের স্ট্যান্ডার্ড।
স্বাধীনতার স্ট্যান্ডার্ড।
রাষ্ট্রের স্ট্যান্ডার্ড।
অবকাঠামোর স্ট্যান্ডার্ড।
মানবাধিকারের স্ট্যান্ডার্ড।
পড়াশোনার স্ট্যান্ডার্ড।
চিকিৎসার স্ট্যান্ডার্ড
আচার-আচরণের স্ট্যান্ডার্ড
ইত্যাদি।
 
আজ আর গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে নয়- কয়েকটা ‘সাধারণ স্ট্যান্ডার্ড’ নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছিলাম।
 
আমেরিকায় মোটামুটি ৪৩ হাজার জিপ কোড রয়েছে।
কোডগুলি নির্ধারিত হয়ে ‘ডাক-সীমানা’ অনুযায়ী। আপনি যে কোন একটা জিপ কোড লিখে অনলাইনে (বা গুগলে) নির্ধারিত এরিয়া ম্যাপটি পেয়ে যাবেন।
 
আপনি যখন একটা নতুন ফোন নাম্বার নিবেন তখন ফেডারেল গভার্ণমেন্ট থেকে অনলাইনেই ‘জিপ কোড’ এড়িয়া হিসাবে অটোমেটিকভাবে একটা ফোন নাম্বার পেয়ে যাবেন।
 
জিপ কোডগুলি হয় ৫ ডিজিট এর।
ফোন নাম্বারগুলি হয় ১০ ডিজিট এর।
 
ফোন নাম্বারের ১০টা ডিজিট সাজানোও থাকে গোছালো ভাবে যেন অতি সহজেই বোঝা যায় এটা কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে। আমেরিকার কান্ট্রি কোড +১ বাংলাদেশের কান্ট্রি কোড +৮৮০। বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই রয়েছে একটা করে কান্ট্রি কোড।
 
নিউ ইয়র্কে আমার একটা মোবাইল নাম্বার ৯১৭-৪৮০-৯৬৫২। লক্ষ্য করুন নাম্বারটি- প্রথম তিনটি ডিজিট এড়িয়া কোড, পরবর্তী তিনটি লোকল কোড এবং শেষের চারটি আপনার ইউনিক মোবাইল নাম্বার।
 
আমেরিকায় ৩২ কোটি মানুষ। বাংলাদেশের ঠিক ডাবল। +১ শুধু আমেরিকারই কান্ট্রি কোড নয়, একই সংগে এটি কানাডারও কান্ট্রি কোড। কানাডার জনসংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। আর এরই সংগে আমেরিকা ও বৃটেনের সংগে আরও গোটা বিশেক টেরিটরি’রও কান্ট্রি কোড এই +১।
 
সর্বসাকুল্যে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের গড়ে একটা করে হলেও মোবাইল নাম্বার ১০ ডিজিটেই সীমাবদ্ধ।
 
এবার চলুন দেখি আমাদের বাংলাদেশ।
ঢাকার এড়িয়া কোড ০২, গ্রামীন ফোনের ০১৭, চিটাগাং এর ০৩১, ঢাকারই একটি থানা দোহারের এড়িয়া কোড ০৬২২৫। বুঝুন ঠেলা। কোডের কোন আগা-মাথা নেই। কোনটা ২ ডিজিট আবার কোনটা ৫ ডিজিট!
 
এরপরও রয়েছে, ঢাকার এড়িয়া কোডের পর আরও রয়েছে ৭টি বা ৮টি নাম্বার। দেশের কোথাও রয়েছে ৩টি নাম্বার, কোথায় ৪টি, ৫টি আবার ৬টিও!
 
আবার দেখুন, মোবাইল অপারেটরগুলি যখন সার্ভিস শুরু করে তখন দেয়া হলো ওদের জন্য ৬ ডিজিট টেলিফোন নাম্বার, এরপর হঠাৎই তা বেড়ে একটি ১ যোগ হয়ে দাড়ালো ৭টি, এখন আবার আরও ১ যোগ হয়ে ৮টিতে দাড়াচ্ছে।
 
অথচ দেশের বিটিআরসি নামে একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এর আবার চেয়ারম্যানও রয়েছে, টিএন্ডটি বোর্ড রয়েছে, আবার টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ও রয়েছে। সেই সংগে দুই লাখ ডলার মাসিক বেতনে একজন তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞও রয়েছে।
 
কিন্তু সভ্যতা নেই, কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই।
 
দেশের সবগুলি এড়িয়া কোড ও ফোন নাম্বারের একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরী করা কিন্তু শুধুই একটা ঠান্ডা মাথায় চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশে সেটা নেই, সেই মানুষ বাংলাদেশে নেই। সুতরাং বাংলাদেশে স্ট্যার্ন্ডডও নেই।
 
আমরা যে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, মোবাইল, টেলিভিশন বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করি তার জন্য ইলেকট্রিক কানেকশন দিতে হয়। এই বিশাল পৃথিবীর সব দেশেই কিন্তু বিদ্যুত ব্যবহার করতে হয়, করে। আর ইলেকট্রিসিটি কানেকটিভিটি’র জন্য আমাদের ইলেকট্রিক প্লাগ ও সকেট (মেইল-ফিমেল) ব্যবহার করতে হয়।
 
আমেরিকায় নির্ধারিত রয়েছে পাতলা বা প্লেন চ্যাপ্টা টুপিন প্লাগ।
অষ্ট্রেলিয়ায় নির্ধারিত রয়েছে চ্যাপ্টা কিন্তু বাকানো টুপিন প্লাগ।
ইওরোপের জন্য থ্রিপিন ফ্লাট, ইন্ডিয়ায় রয়েছে থ্রিপিন রাউন্ড প্লাগ। ইত্যাদি।
 
এবার বলুন তো বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড কি?
কিছুই না। বাংলাদেশের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই- এখানে সবই চলে!
 
বাংলাদেশের একটা স্ট্যান্ডার্ড ছিল, ওজন পরিমাপের স্ট্যান্ডার্ড- সেটা ছিল ‘সেড়’, ‘আধ-সেড়’। সেই স্ট্যান্ডার্ডটি উঠিয়ে দিয়ে কেজি বা কিলোগ্রাম ব্যবহুত হচ্ছে।
 
বাংলাদেশের নিজস্ব কোন স্ট্যান্ডার্ড থাকতে নেই।
ঠিক আছে, না থাকলো।
 
যেহেতু কিলোগ্রাম বা কিলো মিটারে চলেই গিয়েছি তাহলে মিলিয়ন বিলিয়ন ব্যবহার না করে এখনও লাখ, কোটি’র হিসাব নিয়ে বসে রয়েছি কেন?
একটা স্ট্যান্ডার্ডে তো থাকতে হবে- না কি?
 
সারা পৃথিবী কিলো মিটার ব্যবহার করে বা কিলোগ্রাম ব্যবহার করে এই যুক্তিতে বসে থাকলে আমেরিকা কি তার নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ড ধ্বংশ করে দিয়ে এখনও মাইল বা পাউন্ড ব্যবহার করতো?
 
আমেরিকায় সরকারী (ষ্টেট বা ফেডারেল) প্রতিটি ফর্ম এর একটি করে নাম্বার দেয়া রয়েছে। আপনাকে নাম্বার ধরে কথা বলতে হবে। ‘লেটার সাইজ’ পেপার ব্যবহার করা হয় সবকাজেই। এটাই স্ট্যান্ডার্ড।
 
বাংলাদেশে?
ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ণ জমা দিলে দেয়া হয় এক ইঞ্চ সাইজ একটা ‘চুতা’ অথচ এটা কত বড় একটা ডকুমেন্ট একজন নাগরিকের জন্য!
 
কোন কাগজের কোন নির্ধারিত সাইজ নেই, ফর্মের কোন নাম্বারও নেই।
বাংলাদেশের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই।
 
বাংলাদেশের বলতে গেলে রাস্তার কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই, চৌরাস্তার কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই, রোড সিগনালের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই, জামা-কাপড়ের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই, খাদ্য মানের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই, দেশে সরকারী কাজে ব্যবহৃত কাগজের কোন নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড নেই।
 
একটা দেশ।
অবৈধ হলেও একটা সরকার মানুষের ঘাড়ের উপর চেপে বসে রয়েছে।
কিন্তু তারও কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই।
 
গণতন্ত্রের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই।
মানবাধিকারের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই।
স্বাধীনতার কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই।
বিচারের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই।
আইন-শৃঙ্খলা’র কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই।
 
তাহলে কি আছে?
আর, এসব ভাবার মতো ‘স্ট্যান্ডার্ড কোন মানুষ’ও এদেশে নেই।
 
কে জানে- জাতিসংঘ কবে সকলকে নিয়ে বসে ‘বাংলাদেশ’ নামক ভুখন্ডটিকে স্ট্যান্ডার্ডের অভাবজনিত ব্যর্থতায়- না আবার ‘বামন দেশ’ ঘোষনা দিয়ে বসে!
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *