সেটা ২০০৫ এর ঘটনা।চায়না-বাংলাদেশ কুটনৈতিক সম্পর্কের ৩০-বছর পূর্তি উপলক্ষে চাইনিজ গর্ভণমেন্টের রাষ্ট্রিয় আমন্ত্রণে আমরা ২০জনের একটি প্রতিনিধি দল তখন বেইজিং এ। এবার আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো গ্রেট ওয়াল দেখতে।
গ্রেট ওয়াল আসলেই গ্রেট।এই বিশ্বের দু’টি বিষয় নিয়ে আমি অবিরাম মাথা ঘামাই, তার একটি ইজিপ্টের পিরামিড আর অপরটি চায়নার গ্রেট ওয়াল। হাজার হাজার বছর আগে প্রযুক্তিহীন দুনিয়ায় তারা কি মাপের অসাধ্য সব কাজ সফল করেছে- ভাবতে হিমশিম খাই।
(ওরম একটি কিছু যদি বাংলাদেশে থাকতো- তাহলে দেশী ও শাহবাগী, বাম ও আওয়ামী চেতনাবাজরা তখন আর ‘হাজার বছরের ঐতিহ্য’ শব্দযুগল ব্যবহার না করে বলতে পারতো ‘কোটি কোটি বছরের ঐতিহ্য’। কিছু না থাকতেই যদি ‘হাজার বছরের ঐতিহ্য’ বলা যায় তাহলে কিছু থাকলে তো তা কোটি কোটি বছরের হিসাবই করিয়ে ছাড়তো। আমাদের শেখ মুজিব সাহেব অনায়াসেই হয়ে যেতেন ‘ট্রিলিয়ন বছরের শ্রেষ্ট বাঙালী’; বা ডাইনোসার যুগেরও শ্রেষ্ঠতম! ব্রাকেটে দিয়ে দিলাম- মানে এটা মুল লেখার অংশ নয়। চাইলে যে-কেউ এই প্যারাটা বাদ দিয়েও পড়তে পারেন।)
যাই হোক, অনেক বিশাল সাইজের একএকটি সিড়ি। ধরুন, ঢাকার সাধারণ মানের ৩টি সিড়ির সমান ওখানকার একটি সিড়ি; অর্থাৎ অনেক বড় বড় পা ফেলে উচুঁতে উঠতে হয়। সকলের পক্ষে সম্ভব নয় বেশী উপরে উঠা ওই সিড়ি বেয়ে।
আর জানেনই তো যে আমি হাঁটতেই ভালবাসি।আরও ভালবাসা উপরে উঠতে। তাছাড়া আমাদের ঐ সফরে ছিল আমার এক সদ্যপরিচিত ভ্রমণসংগী ফরেন ডিপার্টমেন্টের তরুণ অফিসার রাইস (বর্তমানে আংকারায় বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিষ্টার হিসাবে কর্মরত); তুখোর মেধাবী সে। আমার সংগে ঐ সফরেই দুর্দান্ত বন্ধুত্ব হয়ে উঠে এবং একই সংগে সবকিছুতেই তুমুল প্রতিদ্বন্দীতাও। রাইসও সবকিছুতেই আমার মতোই নাছোরবান্দা। যাই হোক, আমি হাঁটছি, উপরে উঠছি দ্রুততালে। অনেকটা পর আমাদের দলের দলনেতা (একজন সেসময়ের আমলা খালিদ স্যার) কে টপকে আমি আরও উপরে উঠে গেলাম। তিনিও কম যান না ওই বয়সেও। পেছন পেছন দেখতে পেলাম, তিনিও উঠে আসছেন দ্রুততার সংগে।
আমার সে দিকে খেয়াল নেই, আমাকে দেখতে হবে কতটা উপরে উঠা সম্ভব। ঘড়ি ধরে পরিস্কার মনে আছে প্রায় টানা ৯০ মিনিট আমি ওরকম সিড়ি ডিংগিয়ে উপরে উঠেছি, তাপর গায়ের টি-শার্টটিও খুলে ফেললাম। ঘেমে গোসল করে ফেলেছি যেন। মনে হচ্ছিল আর মনে হয় পারবো না, তারপও উঠেই যাচ্ছিলাম সিড়ি বেয়ে।
অতপর নীচে আমাদের দলের বা ট্যুর গাইডকেও না দেখে থামলাম।সিড়িতেই সাইড করে বসলাম। হাঁপাচ্ছিলাম।
তারপর। মিনিট ৫চেক পর দেখতে পেলাম রাইস আসছে, সেও নিজের টি-শার্ট খুলে ফেলেছে। হাত মেলালাম, রাইসকে বললাম ‘আর উঠবো না ভাবছি, তুমি কি উঠতে চাও?’ রাইস বলল, ‘তুমি যদি না উঠো- তাহলে আমিই বা উঠবো কেন? আমাদের উপরে তো আর কেউ-ই নেই।’
বসে বাতাসে শরীর জুড়াচ্ছি।মিনিট দশেক বাদে দেখলাম খালিদ স্যার সংগে আমাদের ট্যুর গাইড টাংহাও আসছে। খালিদ স্যারও জামা খুলে ফেলেছেন, শুধু ট্যাংহাও ফর্মাল ড্রেসে।
আমি আর রাইস একটু এগিয়ে নেমে খালিদ স্যারকে ধরে উপরে তুললাম, তিনি প্রচন্ড ক্লান্ত। বললেন, ‘আমি আর পারবো না, আসলে তোমাদের দেখে লোভ সামলাতে পারিনি তাই উঠে এসেছি; ভীষন টায়ার্ড। এখন নামবো কিভাবে?’ বলে হাসছেন তিনি, হাপাচ্ছেনও।
আমার ৪জন প্রায় মিনিট ২০শেক বাসাতে বসে থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হলাম।
ওখানে বসেই ট্যাংহাও বলল, ‘তোমাদের দেশের একজন জেনারেলও তোমাদের মতো এভাবে দৌড়ে এতটা উপরে উঠে পড়েছিলেন বলে আমাদের একজন অফিসার আমাকে গতকালই জানিয়েছেন।’
আমি টাংকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি সেই জেনারেল এর নামটা বলতে পারো?’
টাংহাও তার ডায়েরী খুলে খুঁজছিল নামটি। ঠিক তখনই খালিদ স্যার বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে চায়নায় সরকারী সফর করেন; তখন তিনি এই গ্রেট ওয়াল পরিদর্শন করেছিলেন।’
টাংহাও নামটি খুঁজে পেয়েছে এবং আস্তে আস্তে বলল, ‘প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া, তিনি সকল প্রটোকল ভেংগে একা একাই এতটা উপরে উঠে এসেছিলেন। তার প্রটোকলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা চিন্তায় পরে গিয়েছিলেন তার নিরাপত্তার কথা ভেবে। তিনি খুবই সাহসী আর দূরদর্শী নেতা ছিলেন। আমি যতটুকু জেনেছি তার সম্পর্কে।’
‘এবং ততটাই সৎ ছিলেন তিনি। ছিলেন বাংলাদেশের সবচে সফল ও করিৎকর্মা রাষ্টনায়ক। তার অকাল মৃত্যুতে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ কষ্ট পেয়েছে, চোখের জল ফেলেছে।’ বলেছিলাম আমি; আর আমার কথায় সমর্থন ছিল রাইসের এবং খালিদ স্যারেরও।