নারী দিবসের শুভেচ্ছা


আজ ছিল বিশ্রী ওয়েদারের একটা দিন।
গত রাতেই ওয়েদার এলার্ট পেলাম- সারাদিনই ভারী স্নো পরবে সংগে হালকা রেইন।
 
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম বাইরে রিয়েল ফিল ট্যাম্পারাচার মাইনাস ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বাড়তি ওভার-কোটি গায়ে জড়ালাম।
 
ভাগ্যিস বাতাসের তীব্রতা ছিল না, তাই রক্ষে।
স্নোগুলি পরছিল যেন ক্যাটস এন্ড ডগস স্ট্যাইলে বৃষ্টির মতো করেই- পার্থক্য শুধুই বৃষ্টিটা ট্রান্সপারেন্ট আর স্নোটা স্বেত-শুভ্র।
 
আর সংগে যেহেতু হালকা বৃষ্টি, সুতরাং মাটিতে সেই হালকা জমা পানির সংগে স্নোটুকু মিশে তৈরী হয়েছে বাংলাদেশের মাটির কাদার আগলে সাদা-কাাঁদা। হালকা পিচ্ছিল।
 
গাড়ী নিয়ে বের হইনি।
অফিস থেকে আজ একটু জলদিই বের হলাম। আমার কালো রঙের ওভার-কোটটিতে লক্ষ্য করলাম ছাতাকে অবহেলা করে স্নোগুলি জড়িয়ে নিয়ে সাদা করে দিয়েছে। ওভাবেই শক্তভাবে হেঁটে সাবওয়েতে গিয়ে ঢুকলাম।
 
সিক্স ট্রেনে উঠবো।
প্লাট ফর্মে যেয়েই দেখি ট্রেন রেডী। আমি সামনে যেতেই ট্রেনের গেটগুলি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু, আমাকে দেখে একটা বিশাল-দেহী ব্লাক মেয়ে তার হাতটা বাইরে বের করে বন্ধ হতে যাওয়া গেটকে আটকে দিল।
 
আর মেয়েটা হাঁসছে আমার দিকে তাকিয়ে। আমিও সম্মানসহ কৃতজ্ঞতা চোখে তাকে ধন্যবাদ দিলাম। মেয়েটার হাত রিলিজ করতে ট্রেনের গেটটি আবারও খুলে গেল আর আমিও ঢুকে গেলাম। মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিলাম, নইলে প্রায় ৮ মিনিট ওয়েট করতে হতো পরবর্তী ট্রেনের জন্য।
 
এদেশে সাবওয়ে ষ্টেশনগুলি এয়ারকন্ডিশনড। ভারী গেট থাকে। গেটগুলি অসম্ভব রকমের মজবুত। সারা দিনে একটা গেট কম করে হলেও হাজার খানেকবার খোলা হয়- বন্ধ হয়; কিন্তু নষ্ট হতে দেখি না কোনদিনও।
 
কেউ যখন গেট খুলে বের হয়, গেটটি ছেড়ে দিলে অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু কেউ-ই এদেশে পেছনে না তাকিয়ে গেট ছেড়ে দেয় না। দেখে পেছনে কেউ রয়েছে কি না? থাকলে গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকে- যতক্ষন না পেছনের মানুষটি গেটে আসে।
 
এই ‘সভ্যতাটুকু’ যে কত বড় একটা শিক্ষা- সেটা ভাবলেও পশ্চিমাদের প্রতি আপনা-আপনিই মাথা নত হয়ে আসে শ্রদ্ধায়।
 
আগেও অনেকবার বলেছি, এদেশে রাত তিনটে বা ৪টায়ও অসংখ্য মেয়েকে দেখি একা একা কাজ থেকে ফিরে বা কাজে যায়। অন্ধকার গলিতেও তারা নির্ভয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
 
নাহ্।
কোন ছেলে ঐ মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকায় না।
 
সাবওয়ে ট্রেনের কারে ছেলে-মেয়েরা একই সংগে যাতায়াত করছে, বিশেষ করে ম্যানহাটনগামী ট্রেনগুলিতে এবং পিক আওয়ারে প্রচন্ড ভীড় থাকে। কারগুলিতে অর্ধেকের বেশীই থাকে মেয়েরা। কোনদিনও কোন একটা মেয়েকে গাড়ীতে ‘বিব্রত’ হতে দেখিনি। ছেলেরা যতটা সম্ভব স্থান করে দেয়ে মেয়েদের; নিজেরাই দুরত্ব বজায় রাখে।
 
বাংলাদেশে থেকে জেনে এসেছি এদেশের মেয়েরা নাকি নেংটা থাকে- যদিও আমি কোনদিন দেখিনি।
 
হ্যা, যেটা দেখেছি কিছু ইয়াং ছেলে-মেয়ে প্রকাশ্য স্থানে বা ট্রেনে চুমু খাচ্ছে; কিন্তু সেই চুমু খাওয়াটাকে কখনও আমি নোংড়ামীর পর্যায়ে নিয়ে দেতে দেখিনি। আর কাউকে কখনও এটাও দেখিনি যে ‘ওসব দৃশ্য’ হ্যাংলার মতো করে তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করতে!
 
মেয়েদের সর্বচ্চো সম্মান করতে দেখা যায় পশ্চিমা দেশগুলিতে, পশ্চিমা ছেলেদেরই। এবং এখানকার মেয়েরাও সভ্যতায় কম যায় না। আপনি হয়তো কোন মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন- একটু বেশীই তাকিয়ে ফেলেছেন। মেয়েটা আপনকে কিন্তু ‘গালি’ দিবে না। চমৎকার মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলবে ‘হাই, হাউ আর ইউ ডুইং?’
 
ততক্ষনে আপনি নিজেই বোকা এবং সভ্যতায় ফিরে যেতে বাধ্য হবেন।
 
আমেরিকায় চাকুরীতে মেয়েদের জন্য কোন কোটা ব্যবস্থা নেই।
এখানকার সিনেটে বা কংগ্রেসে ৪৫ জন বা ৬০ জন করে সংরক্ষিত নারী কোটাও নেই। প্রাথমিক সরকারী স্কুলের চাকুরীতে নেই ৬০% নারী কোটা। ইউনিয়ন কাউন্সিল বা উপজেলা কাউন্সিলেও নেই কোন ভাইস চেয়ারম্যান বা মেম্বার কোটা ব্যবস্থা।
 
‘নারীর ক্ষমতায়ন’ এর নামে নেই কোন ফালতু ব্যবস্থা।
এখানে প্রতিটি ছেলে এবং প্রতিটি মেয়ে নিশ্চিত একজন ‘মানুষ’।
 
শুধুমাত্র মেয়ে হবার জন্য হিলারী ক্লিনটন ‘আলাদা’ কোন সুবিধা এদেশে পায় না- পাবে না। কারণ এরা সভ্য, এরা মানুষ। এরা শুধুই মানুষকেই মুল্যায়ন করা শিখেছে। নারী বা পুরুষকে আলাদা করে নয়। যোগ্যতাতে তারা সম্মান জানায় শুধুমাত্র।
 
আমেরিকার ষ্টেটগুলি নিজ নিজ রাষ্ট্রে সেই ব্যবস্থাটি শতভাগ নিশ্চিত করেছে। এরা স্কুল পর্যায় থেকে মানুষকে সভ্য হতে শিক্ষা দেয়। ব্যস এটুকুই। আর বাকীটার জন্য তৈরী করে দিয়েছে পরিবেশ।
 
নারীর প্রতি সম্মান দেয়া আমি ভারতবর্ষেও দেখেছি।
কোলকাতার পাবলিক বাসগুলিতে বাম সারির সিটগুলি মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। কোন মেয়ে গাড়ীতে উঠলে বাঁ দিকের সিটগুলি ছেড়ে দিতে হবে। যে-কোন সরকারী অফিস আদালাত এমনকি ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসেও মেয়েদের জন্য রয়েছে সম্মান করার আইনসহ কাজে অগ্রধিকার।
 
ভারত-বর্ষ যেহেতু এখনও তার নাগরিকদের শতভাগ ‘মানুষ’ বানিয়ে উঠতে পারেনি- সেহেতু কঠিন আইন করে নারীর সম্মনটুকু রাষ্ট্রিয়ভাবে নিশ্চিত করেছে।
এতটুকুই বা কম কি?
 
ঢাকার পাবলিক বাসগুলিতে উঠেছে অথচ বাস কনডাক্টর থেকে শুরু করে সহযাত্রী কর্তৃক যৌন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে- এরম একটা মেয়েও বাংলাদেশে নেই!
 
কোন একটা গলি বা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা মেয়ে- রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়া ছেলেগুলি ‘টিজ’ করেনি- এরকম একটা উদাহরণও আজ বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না।
 
আর দেশের ছেলেরা যদি মেয়েদের কিছুই না করে বা না বলে- অন্তত ‘হ্যাংলো’র মতো হা করে হালকা জীব বের তাকিয়ে থাকবেই।
 
ঢাকার নিউ মার্কেট বা গাউছিয়া মার্কেটে যাবে একটা মেয়ে অথচ কিছু পুরুষ হাতের নোংড়া স্পর্শ পাবে না- এমনটা ভাবাও অকল্পনীয়!
 
তারপরও আমাদের মা-বোনেরা নীরবে এসব সহ্য করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। কি-ই বা করার আছে তাদের? প্রতিবাদ করে নিজেকে ‘বাড়তি উপভোগ্য’ প্রাণীতে পরিণত করবে? আরও দশজনের ‘চোখের টিজ’ গ্রহন করবে?
 
ওদেশে নাকি এক বছরের মেয়েরাও ধষিতা হয়!
শিট! ঘৃণা ধরে যায় পুরো দেশটার উপর! কিভাবে মানুষ বসবাস করে সেখানে।
 
একজন মা তার চোখের সামনে দেখে নিজ কিশোরী মেয়েকে গণধর্ষন হতে; ধর্ষকদের প্রতি করুণ আর্তনাদ করে মা নাকি বলে ‘বাবারা তোমরা ১জন ১জন করে আসো’!
 
এই হলো দেশ! এই হলো একটা দেশের মানুষ! শেয়াল কুকুররাও তাদের সমাজে বাংলাদেশের মানুষদের চেয়েও সভ্য।
 
বাংলাদেশে জেল হাজতে বন্দী নারীদেরও নাকি ধর্ষন করে থানার পুলিশ, ওসি।
বাংলাদেশে ধর্ষিতা নারীর ফরেনসিক রিপোর্ট পেতে আরেকবার ধর্ষিত হতে হয় ডাক্তারের হাতে!
বাংলাদেশে নববর্ষের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে উলংগ করে ফেলা হয় মা-বোনকে!
বাংলাদেশে শুধু মেয়েদের ধর্ষনই করা হয় না, ধর্ষনের পর হত্যা করা হয় নিরীহ নিষ্পাপ মেয়েটাকে!
 
এসব অতি সাধরাণ বিষয় এখন স্বাধীন বাংলাদেশে! আর চলছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্নয়ন! চেতনাবাজদের দেখা যাচ্ছে এসব ধর্ষন আর ইভ টিজিং এ নেতৃত্ব দিতে!
 
একটা দেশ বা জাতি কতটা সভ্য- তার প্রথম লিসন সে জাতি নারীদের কতটুকু সম্মান করতে শিখেছে।
 
কিন্তু দুঃখজনক সত্যটা হলো- বাংলাদেশে যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থাই আজ ধ্বংশপ্রাপ্ত, শিক্ষার নামে চলছে একটা সম্পূর্ণ জাতিকে ‘জিপিএ-পাইপ’ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র, সেখানে নারীকে সম্মান করার লেসন তো আরও সূদুর পরাহত।
 
একটা মেয়ে বা ছেলেকে ‘মেয়ে’ বা ‘ছেলে’ হিসাবে নয়- ‘মানুষ’ হিসাবে সম্মানটুকু করতে পারলেই এনাফ। কিন্তু সমস্যা হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রই যেখানে তার নাগরিককে ‘মানুষ’ হিসাবে সম্মান করে না- সেখানে ‘একজন’ ‘অপরজন’কে কিভাবে সম্মান করতে শিখবে?
 
চুড়ান্ত অবক্ষয়ের শেষ সীমায় অবস্থান করছে আজ বাংলাদেশ।
একটা জাতি আরও কতটা ধ্বংশপ্রাপ্ত হলে ঘুড়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধী করবে?
 
নাকি এভাবেই একদিন শেষ হয়ে যাবে বাংলাদেশ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *