টিকেট


এই পৃথিবীর সবচে বড় কোম্পানীর নাম হলো ওয়ালমার্ট এবং এর কর্মচারীর সংখ্যা সাড়ে বাইশ লক্ষ। আমেরিকান এই কোম্পানীর সারা পৃথিবীতে সর্বমোট শো-রুম রয়েছে ১১,৫২৮টি। চাল, ডাল, তরি-তরকারী, শাক-পাতা, আলু, বেগুন, পটল থেকে শুরু করে মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ফ্রিজ, জামা-কাপড়, গ্রোসারী, ডাক্তার, ওষুধ, অফিস ষ্টেশনারী, সাইকেল, ব্যাংকের শাখা, ওয়েষ্টার্ণ ইউনিয়েনসহ মোটামুটি সবই পাওয়া যায়।

আমেরিকানরা ওয়ালমার্ট বা কুগার- এসব লোকেশনেই বাজার করতে পছন্দ করে। ডালাসে থাকাবস্থায় আমিও সবসময় ওয়ালমার্ট আর কুগার থেকেই বাজার করতাম।

বাট, সবচে ইন্টারেষ্টিং তথ্যটি হলো নিউ ইয়র্ক সিটিতে কোন ওয়ালমার্ট বা কুগারের শো-রূম নেই। নিউ ইয়র্ক সিটির একটু বাইরে নাছাও কাউন্টিতে নিকটবর্তী ওয়ালমার্ট শো-রূম।

জরুরী কিছু কাজে আমাকে মাঝে মধ্যে ওয়ালমার্ট যেতে হয়। নিউ ইয়র্ক সিটি ট্রানজিটের মেট্রোকার্ড দিয়েই ওই শো-রূমে যাতায়াত করা যায়।
নিউ ইয়র্ক সিটি ট্রানজিট এর মাসিক মেট্রোকার্ড এর মূল্য এখন ১১৬ ডলার। অর্থাৎ এই ১১৬ ডলার দিয়ে আমি সারা মাস নিউ ইয়র্ক সিটির যেখানে খুশী, যতবার খুশী- সিটি বাস বা সাবওয়ে ট্রেনে যাতায়াত করতে পারি। খরচটা নিঃসন্দেহে খুবই কম। আর ট্রেন ষ্টেশনে ঢোকার মুহুর্তে অথবা বাসে উঠার সময় ড্রাইভারের সামনে রক্ষিত সোয়াইপ মেশিনে মেট্রোকার্ডটি সোয়াইপ করে নিলেই হলো।

আমি সাবওয়েতে চলাচল করতেই ভালবাসি যদিও বাস সার্ভিসও অত্যন্ত আধুনিক এবং সহজ।

একদিন ‘গ্রীন আচে মল’ এর ওয়ালমার্ট যাবো। জ্যামাইকা থেকে সিটি বাসে ওঠবো। সিটি বাসের রাস্তাঘাট আমি অতটা ভালো করে চিনি না, সাবওয়ে ট্রেন এর ম্যাপটা যেভাবে মুখস্ত! আগেরদিন কমপিউটার থেকে যাতায়াত ম্যাপ প্রিন্ট করে নিয়ে বের হই- এতে কোন প্রব্লেম হয় না।

একদিন বাসে উঠে মেট্রোকার্ড সোয়াইপ করতে যাবো- ড্রাইভার বলল, মেশিনটি নষ্ট হয়ে গেছে কাজ করছে না; তুমি ভেতরে বসো, সোয়াইপ করা লাগবে না, আই এম সরি। আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম, অন্যরাও দেখলাম তাই করলো।

যাই হোক, ঘটনাটা ভুলেই গিয়েছিলাম।

আমার বাসা ব্রঙ্কস। জ্যামাইকা থেকে সাবওয়ে ট্রেনে আসলে ৩/৪টি ট্রেন চেঞ্জ করতে হয়। কিনতু ‘কিউ ৪৪’ বাসে উঠলে সরাসরি আমার বাসার সামনে নামিয়ে দেয়, সময়ও কম লাগে। শীত শুরু হবার পর আমি বাসে খুব একটা উঠি না। কিনতু গত ১৮ই জানুয়ারী ভাবলাম আজ বাসেই যাবো।
বাসে উঠে আমার মেট্রোকার্ডটি সোয়াইপ করতে গেলাম, ড্রাইভার ‘কি যেন বলল’ এবং হাতের ইশারায় ভেতরে যেতে বলল। আমার সেই ওয়ালমার্ট যাবার নষ্ট মেশিন এর কথাটা মনে পড়ে গেল। ধরে নিলাম আজ এই বাসেরও মেশিনটি নষ্ট; অন্যদেরও দেখলাম আমাকে ফলো করে ভেতরে এসে বসে পরছে।

বিপত্তি বাজলো বাসটি ফ্লাশিং অতিক্রম করার পরই।

লক্ষ্য করলাম দু’জন পুলিশ অফিসার বাসে উঠলো এবং আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করলাম সবার হাতেই একটি করে ছোট টিকেট পুলিশকে দেখাচ্ছে! তাহলে আমি কি কোথাও কোন ভুল করলাম?

যথাসময়ে পুলিশ আমার সামনে এসে আমার টিকেট দেখতে চাইলো, আমার তো টিকেট নেই, মাসখানেক আগেও এই বাসে যাতায়াত করেছি যাষ্ট মেট্রোকার্ড পাঞ্চ করে- টিকেটের কোন বিষয়তো ছিল না! ড্রাইভারই বা আমাকে তখন কি বলছিল? মাথার মধ্যে অনেকগুলি প্রশ্নচিহ্ন দ্রুত দৌড়াচ্ছে। আমি আমার মেট্রোকার্ডটি পুলিশকে বের করে দিলাম এবং বললাম এটা আনলিমিটেড কার্ড- টিকেট কোথায় পাবো ঠিক জানি না। আগে তো কোনদিন টিকেট ছিল না!

পুলিশ আমার কাছে কোন টিকেট দেখতে না পেয়ে আমাকে বাস থেকে নেমে আসতে বলল। আমি বাস থেকে নামলাম। বাসটি আমাকে ছাড়াই ছেড়ে গেল। এবং ১জন অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করল, টিকেট করিনি কেন?

উত্তরে আমি বললাম, এই রুটের বাসে টিকেট সিষ্টেমটি কবে চালু হয়েছে? আমি জানি না।

পুলিশ উত্তরে বলল- কেন, তুমি ড্রাইভারের সামনে ষ্টিকারে প্রিন্ট করা দেখনি যে বাইরের নতুন স্থাপিত মেশিন থেকে টিকেট প্রিন্ট করে নিয়ে বাসে উঠতে হবে এবং এখন আর এই রুটের বাসে কার্ড সোয়াইপ করা যাবে না?

আমি বললাম, না; আমি দুক্ষিত, আমি খেয়াল করিনি বিষয়টি এবং ড্রাইভারও আমাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলেনি।

পুলিশ অফিসার বলল, তোমার আইডি কার্ড দাও।
আমি আমার সিটি আইডি কার্ডটি বের করে দিলাম।

লক্ষ্য করলাম পুলিশ অফিসার হলুদ একটা স্লিপে লেখালেখি করছে। একটু পর আমার কাছে এসে বলল, দেখ- আমি বুঝতে পেরেছি যে তুমি আজই প্রথম নতুন সিষ্টেম চালু হবার পর এই বাসে ট্রাভেল করতেছো, কিনতু সমস্যা হলো আমার দায়িত্ব শুধুমাত্র দেখা কার কাছে টিকেট নেই। আমি তোমার বিষয়টা বুঝেছি এবং আমি দুক্ষিত। কিনতু আমার কিছুই করার নেই; আমি তোমাকে কোন সহযোগীতা করতে পারছি না। তুমি এই টিকেটটা নাও। এখানে ফোন নাম্বার ও ‘ট্যাব’ এর এড্রেস দেয়া আছে। তুমি আজ থেকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে যে-কোন কার্য-দিবসে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে ট্যাব অফিসে যেয়ে জাজকে তোমার ঘটনাটি বুঝিয়ে বলবে; জাজ চাইলে তোমাকে কনসিডার করতে পারবে; আমরা কিছু্ই করতে পারছি না। আর যদি তুমি জাজের কাছে যেতে না চাও; তাহলে তোমাকে ১০০ ডলার ফাইন পেমেন্ট করতে হবে ৩০ দিনের মধ্যেই এবং সেটা তুমি অনলাইনেও পেমেন্ট করতে পারবে। তুমি পরবর্তী বাসে উঠে তোমার গন্তব্যে চলে যাও- তোমাকে টিকেট নিতে হবে না।

আমি চলে আসলাম বাসায়।

বাংলাদেশে কোনদিন কেস খাইনি।
আমেরিকায় এসে কেস খেয়ে গেলাম।

মনে মনে ভাবলাম ফাইন দেবো না- যেহেতু আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন অন্যায় করিনি; জাজের সাথে দেখা করবো, তাকে বুঝিয়ে বললে অবশ্যই সে বুঝবে। যেই ভাবা সেই কাজ।

তাছাড়া এখানকার আইন, বিচার ব্যবস্থা, জাজ দেখার এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে যদি নতুন কিছু শিখা যায়, জ্ঞান অর্জন করা যায় তো মন্দ কি?
ট্যাব অফিসটি ব্রকলীনে।

গেলাম একদিন। চমৎকার ওয়েটিং রুম, আমাকে একটি ফরম পূরণ করতে দিল, জমা দিলাম, ওয়েট করতে বলল।

লক্ষ্য করলাম আমার মতো একই প্রব্লেম নিয়ে আরো অনেকেই এসেছে। এখানে নিউ ইয়র্ক সিটি ট্রানজিটের সকল ফাইন বা টিকেটের মিমাংসা করা হয়। জাজরা ভেতরে বসেন, একজন একজন করে আসেন এবং আসামীকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বিচার করে ছেরে দেন।

আমার পালা আসলো।
একজন পঞ্চাষোর্ধ হোয়াইট ভদ্রমহিলা আমার বিকৃত নাম ধরে ডাকলেন। আমি সামনে যেতেই জাজ- ‘হাই স্যার, হাউ আর ইউ ডুইং টুডে?’ বলে মিষ্টিভাবে তাকে ফলে করতে বললেন।

আমি ভেতরে গেলাম। তার অফিসটা খুবই ছোট। তিনি তার চেয়ারে বসলেন। সামনে টেবিল এবং দু’টো চেয়ার সাজানো। একটায় আমাকে বসতে বললেন। অামি বসলাম।

ওনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ইংলিশে কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলো তোমার জন্য আমি ইন্টারপ্রেটারের ব্যবস্থা করবো এবং এজন্য কোন চার্জ দিতে হবে না; তুমি যে-কোন ভাষায় কথা বলতে পারো।
আমি বললাম, কোন সমস্যা নেই, আমি ইংলিশকেই বেশী লাইক করি ও স্বাচ্ছন্ন বোধ করি।

এবার ভদ্রমহিলা মানে জাজ আমাকে বললেন, দেখ তুমি যদি চাও যে- আজ বিচার হবে না, অন্য দিন হবে বা তুমি যদি সময় চাও- আমাকে বলতে পারো; তোমাকে সময় দেয়া হবে।

আমি এবারো বললাম, আমি খুবই ব্যস্ত; আমি চাই আজই তুমি আমার হেয়ারিং করো এবং ডিসিসান দাও।

এবার সে বলল, ওকে, কিনতু তুমি কি চাও যে- যে পুলিশ অফিসার তোমার বিরুদ্ধে টিকেট দিয়েছে এবং যেই বাস ড্রাইভার ওদিন বাস অপারেট করছিল- তারাও বিচারের সময় উপস্থিত থাকুক? তুমি চাইলে আমি তাদের এখানে উপস্থিত করবো এবং তখন তুমি যদি চাও তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনতে পারবে; আমি অবশ্যই সেটাও খতিয়ে দেখবো।

আমি এবারও বললাম, কোন প্রয়োজন নেই; আমি তোমার সাথেই কথা বলবো এবং সেদিনের প্রকৃত ঘটনাটি খুলে বলতে চাই এবং আমি বিস্তারিত লিখিতভাবে তোমাকে জানাতে চাই।

এবার তিনি বললেন, ওকে। তুমি যেভাবে খুশী থাকো সেভাবেই হবে। এবং তুমি চাইলে আমার দেয়া রায়ের বিরুদ্ধেও আপীল করতে পারবে। তোমার সেই অধিকারও থাকলো।

আমি এবার হেসে দিয়ে বললাম, দেখ আমি তোমার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবো না।

জাজ ভদ্রমহিলা এবার আমার ডান হাত উপরে তুলে আমাকে শপথ বাক্য পাঠ করালেন। এবং আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে শোনালেন। আমি শুনলাম।

এরপর তিনি আমার বক্তব্য শুনতে চাইলেন।
আমি তাকে আমার মতো করে সেদিনের ঘটনাটা বিস্তারিত খুলে বললাম এবং লিখিত পেপারটি দিলাম।

তিনি মর্মাহত হলেন এবং বললেন, আমি দুঃক্ষিত যে তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে টিকেট ছাড়া বাসে উঠোনি এবং তোমার কাছে যেহেতু আনলিমিটেড মেট্রোকার্ডও রয়েছে সেহেতু ভাড়া না দেবার কোন অভিরুচি তোমার ছিল- সেটা প্রমাণ হয় না। ওকে, তুমি বাইরে গিয়ে বস আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার রায় জানিয়ে দেব।

আমি আবার ওয়েটিং রুমে।

অনেক্ষণ পর আমার ডাক পড়লো আবার। রিসিপশনিষ্ট মেয়েটি আমাকে রায়টি হাতে ধরিয়ে দিল এবং রিসিপ্ট সিগ্নেচার নিল। এবং বলল তোমাকে ১০০ ডলার জরিমানা করা হয়েছে।

আমি ঠিক হাসবো না কাদবো বুঝতে পারলাম না।

রায়টি পড়লাম, তিনি বলেছেন ‘যেহেতু আপনার কাছে টিকেট পাওয়া যায় নাই অর্থাৎ সিটি ট্রানজিট আইন ভংগ হয়েছে সেহেতু আপনাকে সিটি আইন অনুযায়ী ১০০ ডলার জরিমানা দিতে হবে। তবে, আপনি চাইলে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে আপীল করতে পারবেন; সেক্ষেত্রে ১০০ ডলার পরিশোধ করে তারপর আপীল করতে হবে এবং আপনি আপীলে বিজয়ী হলে আপনার টাকা আপনাকে ফেরত দেয়া হবে।

আজ একটু আগে ১০০ ডলার ফাইন পেমেন্ট করলাম।

খুব ইচ্ছে ছিল আপীল করবো, দেখবো আর কি কি শিখা যায়। কিনতু সত্যি বলতে কি আমেরিকাতে সময়ই সবচে মূল্যবান।

অনেকক্ষন ভাবলাম।
এবং বুঝলাম সঠিক বিচার হয়েছে।

এটা আমেরিকা। আমেরিকা অাইনের দেশ, আইন প্রয়োগ এর দেশ।

বিচারক, পুলিশ কেউ আইনের বাইরে কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। কাজেই, আমাকে আরও সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হবে- আইন বুঝে, মেনে চলতে হবে।

আমার এই শিক্ষাটা অনেক বেশী দরকার ছিল।
আই এম হ্যাপী।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *