জাতীয় প্রবৃদ্ধির সেই গল্পটা


২০০৩ সালে যখন প্রথমবার চায়না মেইনল্যান্ডে যাই তখন, পরিস্কার মনে আছে তখন ডলার প্রতি আরএমবি বা রিনমিমবি’র রেট ছিল কমবেশী ৬.২৫।
 
তখন চাইনিজ রিনমিমবি’র সংগে বাংলা টাকার রেট ছিল কমবেশী ১৩.৫০।
 
সেই ২০০৩ সালে ১টি ইউএস ডলারের সংগে বাংলা টাকার বিনিময় মূল্য ছিল কমবেশী সর্বোচ্চ ৫০ টাকার মতো; বর্তমানে এই ২০১৯ সালে ১ ডলারে পাওয়া যায় ৮৭টি বাংলা টাকা। ইনশাল্লাহ আগামী ৫ বছরের মধ্যে ১ ডলারে ১০০টা বাংলা টাকা মিলবে।
 
এবং লিখিত দিয়ে বললাম, তখনও আপনাকে ১ ডলারে ৬.৫০’র কাছাকাছিই পরে থাকবে রিনমিমবির বিনিময় হার।
 
এবং তখনও ১ আরএমবি’তে মিলবে কমবেশী ১৩টি বাংলা টাকা।
 
বিষয়টাকে কি বেশী জটিল করে ফেললাম?
 
না। একটু বুঝুন- আজ থেকে ১৫/১৬ বছর ধরে ইউএস ডলারের অবমুল্যায়ন হয়েছে, মারাত্মক অবমূল্যায়ন হয়েছে বাংলাদেশী বাংলা টাকার কিন্তু শক্তিশালী হয়েই নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে চাইনিজ আরএমবি।
 
চাইনিজ আরএমবির সংগে শুধুমাত্র ডলার কেন- বিশ্বের কোন মুদ্রাই প্রতিযোগীতায় টিকতে পারছে না।
 
আমেরিকা বার বার চায়নাকে হুমকী দিয়েছে আরএমবি’র অবমূল্যয়ন করার; অভিযোগ করেছে আমেরিকা- চায়না নাকি জোর করে তাদের ইউয়ানের মূল্য ধরে রেখেছে!
 
কিন্তু চায়না কাউকে কোন পাত্তাই দেয়নি কোন কালেও।
 
ইন্ডিয়ান রুপির গল্প শুনবেন?
সেই ২০০০ সাল থেকেই তাদের দেখে আসছি বাংলা টাকার সংগে প্রতিযোগীতাতে সীমাবদ্ধ থাকতে। একবার একটু বাড়ে একবার একটু কমে। এখনকার অবস্থা বড়ই করুণ। প্রায় ৭০টি রুপি প্রয়োজন হয় একটি ডলার কুড়াতে! বাংলা টাকার মতোই বেহাল অবস্থা নিয়ে তারাও নাকি অর্থনৈতিক পরা শক্তি- এখানে বস্তা খানেক হাসির ইমো দিতে পারলে মজা পেতাম।
 
ইন্ডিয়াকে আমি কোন কালেই কোন ‘শক্তি’ হিসাবেই গণনা করিনি, আজও গণনায় আনছি না; আগামী ১০০ বছর পরও ইন্ডিয়া কোন বাস্তবিক গণনায় যাবার যোগ্যতা অর্জন করবে না।
 
ইন্ডিয়া বাদ থাক। চায়না নিয়ে বলছিলাম।
 
বাংলাদেশে এখন নাকি উন্নয়নের মহাউৎসব চলছে!
দেশী-বিদেশী পত্রিকাগুলি নাকি দিনভর এই উন্নয়নের মহাসাগরের প্রশংসার পঞ্চমুখ, দ্রুত বেড়ে উঠা অর্থনীতি হিসাবেও নাকি বিস্ময়কর মূল্যায়ন পাচ্ছে; আবার কেউ কেউ নাকি আজ উন্নয়নের রোল-মডেলও!
 
এসব যখন শুনি বা দেখি কিংম্বা পড়ি- তখন প্রচন্ড হাসিতে তলপেটে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। হায়রে বেকুবের দল! করুণা করতে আমার লজ্জাবোধ হয়।
 
মাঝে মধ্যে শুনি ৭.৫ মাঝে মধ্যে শুনি ৮ এর উপরে নাকি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি রেট!
 
প্রবৃদ্ধি বা গ্রোথ বুঝতে আপনাকে সর্বপ্রথম দু’টি বিষয় বুঝতে হবে। আপনাকে বুঝতে দেশটির সক্ষম বা কর্মক্ষম জনসংখ্যা কত এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক মানদন্ডে দেশটির অবস্থান কেমন?
 
আপনি গল্প জুড়ে দিবেন- দেশে কোন বেকার নেই!
আপনি গল্প জুড়ে দিবেন- দেশে মাথা পিছু আয় বেড়েছে!
 
এসব বলে আপনি মুর্খদের তুষ্ট করতে পারবেন।
কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে আপনি যখন দু’চোখ দিয়ে অসহায় ১৭ কোটি অসুখী অভুক্ত মানুষের দিকে তাকাবেন- তখনই বুঝতে পারবেন ‘ফুলিয়ে ফাপিয়ে উঠানো কিছু সেলফ ক্রিয়েটেড সংখ্যা’ দিয়ে প্রবৃদ্ধির রচনা লেখা আর গরু রচনা লেখা একই বিষয়। বাস্তবতায় কোন হেরফর হয় না তাতে।
 
দেশে কোটিপতি বা বিলিয়নিয়ার (হাজার-কোটি পতি)’র সংখ্যা বাড়ছে- কারণ সরকারী কেনা-কাটার নামে কিছু অমানুষ লাগামহীন টাকার মালিক হচ্ছে; তারা টাকা পাচার করে পাঠাচ্ছে কানাডায়, আমেরিকায়, মালয়েশিয়ায়। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে কেউ একজন সিংগাপুরের সেরা ধনীতে পরিণত হয়েছে।
 
আর এই লাগামহীন টাকার মালিকদের সংখ্যটা এবং টাকার পরিমাণ এখন বাংলাদেশে এতটাই বেড়ে উঠেছে যে এই সামান্য কিছু টাকাওয়ালার কাছে ১৭ কোটি মানুষের সামগ্রিক অর্থনীতিও খুবই ক্ষুদ্রতায় গিয়ে ঠেকে! কষ্ট হয় ভাবতে!
 
এসব করে দেশের কোন উন্নতি হয় না।
১০ হাজার কোটি টাকায় করা সম্ভব এমন সেতু তৈরী করার কথা বলে ৫০ হাজার কোটি টাকা সরকারী বরাদ্দ দেয়ার নামে ৪০ হাজার কোটি টাকা মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে খেয়ে দিচ্ছে কিন্তু ঐ ৫০ হাজার কোটি টাকাকেই উন্নয়নের গল্পে শেষ মেশ ন্যাশনাল প্রবৃদ্ধিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন!
 
বাংলাদেশে নাকি একটা এয়ারপোর্ট তৈরী করা হবে- বাজেট ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর এই তো সেদিন, গেল সপ্তাহে পাকিস্তানের বেলুচিস্থানে এই পৃথিবীর সবচে বড় এয়ারাপোর্ট করার চুক্তি সই করা হলো- সেটার বাজেট মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশে আদতে একটা এয়ারপোর্ট করার নামে ৩০ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রিয় লুটের নেতৃত্ব চলছে! আর কিছুই না!
 
ভারতে যে ব্রীজটি তৈরীতে খরচা হয় ৬০০ কোটি টাকা বাংলাদেশে সেটা তৈরীতে খরচ হয় ২০ হাজার কোটি টাকা! ভাবতে পারেন? পারবেন হিসাব মিলাতে?
 
এটা কোন হিসাবে নয়।
এসব কোন যোগ-বিয়োগও না। না কোন জিডিপির হিসাব বা প্রবৃদ্ধির অংক! সবই চুরি, আর জানেনই তো যে, চোরের মা’র বড় গলা।
 
৩০ টাকা দামে কয়েকজন মাত্র হাতে গোনা ব্যক্তির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে সেটা ৬টাকা বিক্রি করার নামে ইউনিট প্রতি রাষ্ট্রের ২৪ টাকা করে প্রতি মুহূর্তে খেয়ে দিচ্ছেন আর গল্প শোনাচ্ছেন বিশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উন্নয়নের! কত লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছে সামান্য কয়েকজন ব্যক্তি!
 
লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা এভাবে প্রতি বছর হাত-সাফাই করা হয় এবং এই টাকাগুলিই উন্নয়নের অংকে গেলানো হয়, প্রবৃদ্ধি হিসাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়!
 
এভাবেই কৃত্রিম প্রবৃদ্ধির খেলা, কৃত্রিম মাথাপিছু আয় বা জিডিপি তৈরী করা হয়।
 
এসব করে সাময়িকভাবে কিছু অসাধু, অসুস্থ্য প্রচারণা দেখানো যায় মাত্র- কিন্তু ১৭ কোটি মলিন মুখের দিকে তাকলে তখন আর এসব নোংড়া খেলা মুখ বুঝে সহ্য করা যায় না।
 
শরীরের রক্ত গরম হয়ে যায়!
 
বিগত প্রায় ৪০ বছর যাবৎ প্রকৃত উন্নয়নের চমক দেখিয়ে যাচ্ছে চায়না, আর তাইতো শুরুটাও করেছিলাম চায়নিজ আরএমবি দিয়েই।
 
আজ থেকে ৩০ বছর আগেও শুনেছি, জেনেছি চায়না দাবী করেছে তাদের প্রবৃদ্ধি নাকি ৫, কখনও ৫.৫ আর এখন নাকি ম্যাক্সিমাম ৬.৬।
 
আর বাংলাদেশের নাকি ৮.৫ হয়ে যাচ্ছে!
এসব গাজাখড়ি প্রবৃদ্ধির গল্প আম্লীগের নেতা-কর্মীদের বোঝান, ওরা বানরের মতো লাফালাফি করুক। এদের কাছে ৩ লাখ আর ৩ মিলিয়ন একই সংখ্যা, শুধুমাত্র সুবিধেমতো বসিয়ে দিয়ে ফায়দা লুটা আর কি!
 
যারা প্রকৃত হিসাব বুঝে- তারা কখনও প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে গল্প তৈরী করে না।
 
চায়নাকে হুমকী দিয়েও তার আরএমবি বা রিনমিমবির দাম বাড়ানো যায় না, অবমূল্যায়নও হয় না। আরএমবি এক শক্ত গিড়ো দিয়ে বসে রয়েছে তার নিজের অবস্থানে আর ডলারকেই উল্টো ঘুড়াচ্ছে তার চারপাশে- তারপরও চায়নার প্রবৃদ্ধি বাড়ে না।
 
তারা নিজেদের উন্নয়নের রোল মডেলও দাবী করে না; তবে বাদবাকী বিশ্ব বলে।
 
এই নৈরাজ্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি কামনা করছি।