আমার পাঠকরা এতদিনে বেশ বুঝে ফেলেছেন যে আমি ভ্রমনের পাগল।
সুযোগ পেলেই ছুটে যাই- আগে পিছে কিছুই ভাবি না।
‘করিয়া ভাবিও কাজ, ভাবিয়া করিও না!’ এটা আমার একান্তই নিজস্ব তত্ত্ব- কেউ ফলো করতে যাবেন না কিন্তু!
যে যাকগে। একবার গেলাম মাধবকুন্ডু জল প্রপাতে। আগেও অনেকবার গিয়েছি- কিন্তু মন তো ভরে না; তাই আবারও যাওয়া।
ক্ষুধা লেগেছে- ওখানে কয়েকটা রেষ্টুরেন্ট রয়েছে কিন্তু আমার পছন্দ হলো ওখানকার একটা অতি ক্ষুদ্র টং দোকান- খিচুরী বিক্রি করছে ছেলেটা সংগে একটা এসিসটেন্ট। আমি দোকানে ঢুকে বললাম, ‘খিচুরী খাবো, একটু ভালো করে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে যদি দিতে পারেন- তাহলে খাবো, সংগে বকশিশও দিবো?’
বিক্রেতা খুশী এবং রাজী হলো।
ঝটপট সে গরম পানি দিয়ে প্লেট পরিস্কার করে ফেলল। বেশ সুন্দর করে খিচুরী সংগে ডিম ভাজি নিয়ে আসলে। আমাদের বসার জন্য চেয়ার-টেবিলগুলিও বেশ যত্ন করে পরিস্কার করে দিতে ভুললো না।
খিচুরী চেহারাটা বেশ ভালই ছিল।
আমিও বেশ আগ্রহ নিয়ে খাবো- হাত ধুয়ে প্লেটে হাত দিলাম। তারপর বেশ করে মাখিয়ে মুখে তুললাম।
সবই ভালো ছিল- কিন্তু লবন কৈ? লবন ছাড়া খিচুরী তো আমি খেতে পারি না!
এ ঘটনারও প্রায় বছর দু’য়েক পর।
আমি গেছি গৌহাটি। ওখান থেকে ফিরবো আগরতলা। ‘ভারত বনধ’ পরদিন। বিকেল ৪টায় বাস ছাড়বে পরদিন সকালে আগরতলা পৌছবো। সেভাবেই বাসে উঠলাম।
শিলং এ রাতে যাত্রা বিরতী। হাবিজাবি খেয়ে নিলাম। তারপর আবার বাসযাত্রা শুরু হলো।
কিন্তু কপাল মন্দ।
ভোর বেলা আমাদের বাস এর ইঞ্জিন এ গোলযোগ দেখা দিল।
একটা ছোট বাজারে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলা হলো বাস আর যাবে না- আপনারা পাশেই একটা রেল ষ্টেশন রয়েছে ওখান থেকে আগরতলা যেতে পারবেন।
১১টা নাগাদ ট্রেন আসবে।
১১টা মানে অনেক দুর।
এতে আমি কিন্তু কষ্টের চেয়ে আনন্দই বেশী উপভোগ করি। নতুন আরও একটা জায়গা দেখার লোভ, নতুন কিছু মানুষের সংগে পরিচয় ও কিছুটা সংগ। নতুন কিছু খাবার ইত্যাদি লোভ তো আমার মজ্জাগত।
হাঁটাহাটি করে এলাকাটা দেখলাম। অজো পাড়াগাঁ। গ্রামের নাম ‘পানিসাগর’ গুগল ম্যাপ বের করে দেখলাম জায়গাটা ঠিক মৌলভীবাজারের সেই মাধবকুন্ডু জলপ্রপাতের পুব দিকে ভারতীয় সীমান্তঘেষা।
বেশ মজা পেলাম। কোনদিনও আমার এমন একটা জায়গায় বেড়ানোর সুযোগ হতো না। এজন্য একটু বাড়তি আনন্দ এবং উত্তেজনা রক্তের প্রতিটি কনিকায়।
টিউবওয়েল খুজে বের করলাম, ফ্রেস হলাম।
একটু পর দেখলাম বাজারে একটা ছোট টং রেষ্টুরেন্টের মতো, সেখানে খিচুরী বিক্রির আয়োজন চলছে।
আমি উপস্থিত হলাম, খিচুরী খাবো।
খিচুরী দেয়া হলো প্লেটে করে। খুবই আগ্রহ নিয়ে মুখে দিলাম।
কিন্তু একি? লবন নেই কেন?
আর ঠিক তখনই আমার সেই মাধবকুন্ডুর খিচুরীর কথা মনে পরে গেল।
আর তখনই মনে হলো মাধবকুন্ডু আর পানিসাগর তো একটাই মহল্লা। ১৯৪৭ এদের আলাদে দেশে পরিণত করেছে। মানুষগুলি, তাদের ফুড-হ্যাভিট সব একই রয়েগেছে।
সে এক অন্যরকম ভালো-লাগা।
আমার আনন্দটুকু শুধু আমি একাই উপভোগ করতে পারছিলাম।
আমি সত্যিই এক অদ্ভুত আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন- যদিও খিচুরীটা আর খাওয়া হলো না।
আমি তখন ঢাকার নবাবগঞ্জে ব্যবসা করি।
সেখানকার একটা নাট্য সংগঠন নবাবগঞ্জ থিয়েটার। সেই ‘নবাবগঞ্জ থিয়েটার’ যাবে রাজশাহীর পুঠিয়া- চট্রগ্রামের পুটিয়া নয় কিন্তু।
নাটকের সংগে আমার দূরতম কোন সম্পর্কও নেই- তারপরও সেই সংগঠন এর সভাপতি তোতা কাকা আমাকে সংগে নেবেনই।
আর আমি তো যাবো-ই।
গেলাম।
ভোড় বেলা আমরা একবাসভর্তি করে পুঠিয়া গিয়ে উপস্থিত হলাম। চমৎকার মনোমুগ্ধকর একটা স্থান পুঠিয়া। আমার ভাল লেগে গেল। ফ্রেস হয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম।
৮টা সাড়ে আটটার দিকে বলা হলো ‘সকালের খাবার রেডী’।
গিয়ে বসলাম। আবার খিচুরী।
দেখতে মনে হলো দারুণ হয়েছে- খুবই আগ্রহ নিয়ে বসে রয়েছি খাবো।
প্লেটে খিচুরী দেয়া হলো।
মুখে দিলাম। খিচুরীটা সত্যিই অসাধারণ ছিল কিন্তু খাওয়া যাচ্ছিলা না কারণ চালটা ধৌয়ার সময় বাবুর্চি বালু-মিশ্রিত পানি ব্যবহার করে ফেলেছে; দাতে কিচকিচ করছিল।
ঠিক তখনই আয়োজনকারী কোন কর্মকর্তা আমার সামনে এসে জানতে চাইলেন ‘ভাই খিচুরী কেমন হয়েছে? খেতে পারছেন তো?’
আমি নির্দিধায় জবাব দিলাম, ‘না বেশ ভালই তো হয়েছে শুধু বালুটা একটা বেশী হয়েছে!’
ব্যবসার কাজে গেলাম সুরাট।
মুম্বাই থেকে এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রায় চার ঘন্টার জার্নি। সুরাট গুজরাত প্রদেশে অবস্থিত। থ্রি ষ্টার হোটেলে উঠেছি, ৩০০০ রুপি ভাড়া সংগে কমপ্লিমেন্টাল ব্রেকফাষ্ট।
সকালে ব্রেকফাষ্ট করতে ডাইনিং এ গেলাম। রেডীমেট খিচুরী সংগে ঝুরা ডিম ভাজি এবং পেয়াজ কুঁচি। ভিন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন পরিবেশনায়, ভিন্ন স্টাইলে রান্না করা খিচুরীটা সেদিন সত্যিই অসাধারণ ছিল।
এই খিচুরীটাই বাংলাদেশের প্রায় বেশীরভাগ অঞ্চলেই ঈদের দিনের সকালের প্রধান আয়োজন।
বিশেষ করে গ্রেটার ঢাকা এবং এর আশ-পাশের জেলাগুলো ঈদের সকাল এবং সম্ভবত সারা দেশের বৃষ্টিকালীন কমন খাবার খিচুরী।
আমার বাসার কাছেই ‘প্যাকস্যান’ রেষ্টুরেন্টে প্রতিদিন সকালেই তৈরী হয় খিচুরী। কোন কোন দিন একটু বেশী সকালে আমি অফিসে গেলে ঐ রেষ্টুরেন্ট থেকে মাত্র ৭ ডলারে একটা খিচুরী নিয়ে অফিসে যাই। বেশ মজা করে তৃপ্তি নিয়ে খাই।
বাঙালীর খাবার মেনুতে খিচুরী সত্যিই এক দুর্দান্ত ও চমৎকার আয়োজন।
আমার মা- আমি ঠিক জানি না কেন শুধুমাত্র ঈদের দিনের সকালে রান্নার আয়োজনে খিচুরীতে ‘পোলাও পাতা’ দিয়ে রান্না করতেন। মা’র হাতের সেই রান্না করা খিচুরীর স্বাদ পাইনা আজ তিন-চার বছর।
জানি না কবে আবার খেতে পারবো।