‘ক্রীম হিন্দু’


আমার জীবনের একটা অনেক বড় সময় কেটেছে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের হোটেলে আর বিভিন্ন এয়ালাইন্সের ফ্লাইটে। অনেক বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি হয়েছি জীবনে।
 
২০১১ সালের কোন বিকেলে কোলকাতার নিউ মার্কেটের কাছে (সম্ভবত সদর ষ্ট্রিটে) একটি হোটেলে উঠলাম। দোতালার একটি রুমে; রুমটি গোছানো পরিপাটি। আমি আবার গোসল শেষ করে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকি শরীর শোকানোর জন্য; ছোট বেলার অভ্যাস (বা বদঅভ্যাস!), ফ্যানটাও ছেড়ে দিই।
 
ওদিন এসির মধ্যেও ফ্যানটা ছাড়লাম। হঠাৎ ইন্টারকম বেজে উঠলো।
ওপাশ থেকে এক ভদ্রলোক সুন্দর বাংলায় আমাকে অত্যন্ত অনুরোধরে স্বরে বললেন, ‘তৌফিক সাহেব, আমি এই হোটেলের মালিক। আপনি যদি ফ্রি থাকেন কাইন্ডি আমি আপনার সাথে কিছুক্ষন কথা বলবো।’
 
আমি একটু অবাক হলাম। কি কথা বলতে চান ভদ্রলোক! আমি বললাম, ‘ঠিক আছে আমি থার্টি মিনিটসের মধ্যে নীচে নামবো। ওয়েট করেন।’
 
বাঙালী বাবু আমাকে সালাম দিয়ে ওনার নাম বললেন। ওনার বয়স আনুমানিক সেভেনটি ফাইভ। আমি হাত মেলালাম। ওনি বললেন, ‘দেখুন আমি হঠাৎ গেষ্টদের নাম-ঠিকানা দেখছিলাম, আমার এ হোটেলে বাংলাদেশীরা তেমন একটা ওঠে না। আপনিও সম্ভবত আজি প্রথম উঠলেন। কিনতু সে কারণে নয়; আমি আপনার পার্মানেন্ট এড্রেসটা দেখে নষ্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। এছাড়া ড্রয়ারে আপনার পাসপোর্টটিও দেখলাম। কৌতুহল হলো আপনার মতো মানুষের সাথে একটু কথা বলার।’ তিনি বলতেই থাকলেন এক নিঃশ্বাসে, ‘আমার বাড়ী নবাবগঞ্জ থানার গোবিন্দপুর গ্রামে। আপনার বাড়ী দোহার থানার আউলিয়াবাদ। আমরা একটা অঞ্চলের মানুষ। আমি তখন খুব ছোট, বান্দুরা হলিক্রস স্কুলে পড়ি। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দু’টি দেশ হয়ে গেল। আমার দাদা-বাবা-চাচারা দেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসলো পুরো পরিবার নিয়ে; তারপর আমরা কোলকাতাতেই থিতু হলাম। অনেক অনেক বছর দেশে যাই না। ছোট বেলার স্মৃতি এখনও আমাকে কাঁদায়। অনেক বন্ধু ছিল আমার।’
 
এভাবে ভদ্রলোক অনেক কথা বলতে থাকলেন। আমার খুব ভাল লাগলো ওনার সাথে কথোপোকথনে।
 
আমার সম্পর্কে কৌতুহল নিয়ে জানলেন; দেশ, বিশেষ করে দোহার-নবাবাগঞ্জের মানুষগুলি কেমন আছে? ইত্যাদি। এলাকার রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, পরিবেশ সবকিছু খুঁটিয়ে খুটিয়ে জানলেন। একসময় ওনার চোখে আমি একটু জলও দেখতে পেয়েছিলাম; চোখ মুছলেন সাদা ধুতি উঠিয়ে।
 
ওদিন আমার কোন কাজ ছিলো না; প্রায় ঘন্টাখানেক আড্ডা দিলেন, চা খাওয়ালেন।
একথা সেকথা বলার এক পর্যায়ে ওনি একটা কথা বলে ফেলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রীম হিন্দুরা তো সেই ১৯৬৫ সালের আগেই দেশ ছেড়ে চলে এসেছে ভারতে।’ ওনার এ কথাটায় আমি কিঞ্চিত থমকে গেলাম! নিজের মধ্যে হিসাব মেলালাম।
 
আমি যে স্কুলে পড়াশোনা করেছি সেই বান্দুরা হলি ক্রস হাই স্কুলের বেশীরভাগ শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু। বাংলাদেশের অনেক স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিাদ্যালয়ে অনেক মেধাবী, অভিজ্ঞ হিন্দু শিক্ষক, বা প্রশাসনে অনেক হিন্দু সৎ অফিসার আমি দেখেছি। অটোবির নিতিন কুনডুর মতো মানুষও পেয়েছে বাংলাদেশ।
 
ভদ্রলোক ওনার কথায় অবিচল। ওনিও যুক্তি দিলেন অনেক। জ্যোতি বসু, ড. অমর্ত্য সেনের কথাও তুললেন। আরোও অনেক কিছুই বললেন। একটা পর্যায়ে আমি ওনার কাছে হার মানলাম; ওনি কিনতু ‘ক্রীম হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে কয়জন ‘ক্রীম হিন্দু’ আছেন? প্রম্পট, ডায়নামিক কাউকে পেয়েছেন? আসলেই তো!
 
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো কালো বিড়াল বাংলাদেশের সংবিধান লিখে! অঞ্জন রয়, শ্যামল দত্ত আর মুন্নি ও সাহারা দিনরাত সংখ্যালঘুর সবক দেয়!
 
আমি সত্যিই বাংলাদেশের ‘ক্রীম হিন্দু’ খঁজছি।
আচ্ছা! বাংলাদেশে কি কোন ‘ক্রীম মুসলমান’ আছে?
 
হাসিনা খালেদা’রা যে-দেশের প্রধানমন্ত্রী- সেদেশে কি আদৌ কোন ‘ক্রীম পুরুষ মানুষ’ রয়েছে?