‘ইও ব্লাডি স্যাট-আপ’
১৯৯২ বা ৯৩ সালের দিকের একটি কথা।
বাংলাদেশের এটর্ণী জেনারেল আমিনুল হক সাহেব প্রকাশ্য আদালতে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেছিলেন আসামী কাঠগড়ায় দাড়ানো সাবেক প্রেসিডেন্ট লেফটেনেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সাহেবকে।
ইত্তেফাকের সেদিনের হেডিংটি আমার আজও মাথায় গেঁথে রয়েছে।
আমার সদ্য কৈশর উত্তর্ণি মন বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে একজন সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্টকে এভাবে কথা বলাটা মেনে নিতে পারেনি- আর তাইতো আজ ২৬ বছর পরও সেই কথাটা হুবুহু মনে রয়েছে।
দেশের একজন এটর্ণী জেনারেল যখন শিষ্ট্রাচার ভুলে যান, সভ্যতা ভুলে যান, ব্যক্তিগত আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ তাও ভুলে যান- তখন বোঝা যায় একটা দেশ দ্রুতই নীচে চলে যাচ্ছে; গেছেও তাই।
দেশতো সে-সময় থেকেই নীচে নেমে যাচ্ছে।
দেশের মানুষ অসভ্যতাকে পুজি করে সামনে এগিয়ে যাবার কথা ভাবছে- যেটা অসম্ভব।
একনায়ক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে গণআন্দোলনের মাধ্যমে বিদেয় করেছে এদেশের সর্বস্তরের মানুষ, বেসিকেলী ছাত্ররা; তরুণরা।
একটাই উদ্দেশ্য ছিল- দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
হয়নি। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবার পর কথায় কথায় বলতেন ‘বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার’; আমি শুনতাম আর হাসতাম। বিজ্ঞানের ছাত্র আমার পক্ষে ‘গণতন্ত্র’ অর্থ বুঝা হয়তো বা সম্ভব ছিল না- কিন্তু ওতটুকু ঠিকই বুঝতাম যখন দেখলাম সেদিনের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া- তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার যোগ-সাজছে জাতীয় সংসদে একটা আইন প্রণয়ন করলেন ‘কোন এমপি যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে কোন প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়- তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে’!
এটাকে গণতন্ত্র বলে না।
আমরা এটাও দেখেছিলাম সমঅধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে আওয়ামী জাতির জনক শেখ মুজিব পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা বিষেদাগার করে অশিক্ষিত বোকা বাঙালীদের খেপিয়ে দিয়ে ‘শুধুমাত্র পুর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে’ উভয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবীদার হয়ে উঠেন। দেখেছি সুচতুর আরেক জ্ঞানপাপী জুলফিকার আলী ভু্ট্টো, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের নেতা শেখ মুজিবের ক্ষমতার লড়াই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়।
বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামের আরও একটা দেশ জন্মলাভ করে।
দেশবাসীর আশা ছিল দেশে সমঅধিকার নিশ্চিত হবে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। শেখ মুজিব দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ হত্যা করে একদলীয় বাকশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশকে এক চরম অস্বত্বিকর দেশে পরিণত করেন এবং পরিবার-কেন্দ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার নামে দেশবাসীর উপর দুঃশাসন চাপিয়ে দেন, লুটতরাজ, চাঁদাবাজী, হত্যা, গুম, ক্রস-ফায়ার আর দুর্ভিক্ষের দেশে পরিণত করেন।
গণতন্ত্র সুদুর পরাহত হয়।
এরশাদ’কেও দেশের যুব সমাজ প্রত্যাখান করে- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে।
আমরা সেদিন গণতন্ত্র পাইনি।
এরশাদ পদত্যাগ করলেন। আটক হলেন। তার মানবাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হলো।
তারপরও দেশের মানুষ এই স্বৈরাচারী এরশাদকে ৫টি আসনে বিপুল ভোটে নির্বাচিতসহ তার দলকে ৩৫টি আসনে বিজয়ী করে আনে। সেসময় এরশাদকে টেলিভিষনে একটা ভাষনও দিতে দেয়া হয়নি। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন ‘বিচারপতি-সুলভ’ আচরণ এরশাদের সংগে করেননি, অবিচার তিনিই শুরু করেছিলেন। কারো প্রতি বিরাগ না প্রদর্শনের ‘শপথ’ করে বিচারপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন শাহবুদ্দিন সাহেব!
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে সেদিন ঐ এরশাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের একজন মানুষও তার প্রতিবাদ করেনি সেদিন।
এভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না; হতে পারে না।
আমাদের ভুলে যাওয়া অনুচিৎ হবে যে; সম্পূর্ণ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাওয়া সত্বেও ২০০৮ এর শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বেগম জিয়ার বিএনপি মাত্র ৩৫টি আসন পেয়েছিল। আমি জানি না দেশে এরশাদ না বেগম জিয়া- কে বেশী জনপ্রিয় ছিল?
আমি স্মরণ করতে পারি- সেই স্বৈরাচারী এরশাদ সাহেব সম্পূর্ণ প্রতিকুল পরিবেশে থেকেও নির্বাচন করে ৩৫টি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন, ১০০র বেশী আসনে মাত্র শতাধিক ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। শুধুমাত্র ‘এরশাদ’ কে হঠাতে- আওয়ামী লীগ আর বিএনপি মিলে তাদের প্রতিষ্ঠাতাদের মূল আদর্শ ‘প্রেসিডেন্টশিয়াল শাসন-পদ্ধতি’র বিরুদ্ধে গিয়ে পালামেন্টারী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এভাবে গণতন্ত্র হয় না।
সাময়িক জোরাতালিতে গণতন্ত্র গণতন্ত্র খেলা হয় না।
বেগম জিয়ার হাতে সুযোগ ছিল দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার; যেমনটা করেছিলেন তারই স্বামী, দেশের মানুষের সবচে প্রিয় প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। প্রেসিডেন্ট জিয়া অন্তত ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠায় বা দেশ শাসনে কোন জোরাতালি দেননি কোনদিনও।
আমার পরিস্কার মনে আছে, ঢাকার নিম্ন আদালত এরশাদের বিভিন্ন বিদেশী সরকার প্রধানদের কাছ থেকে পাওয়া বেশ কয়েকটি অস্ত্র নিজের কাছে রেখে দেয়ায় ‘অবৈধ অস্ত্র’ রাখার অপরাধে ৭ বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল।
কিন্তু মজার বিষয় ছিল ঐ একই মামলায় উচ্চ আদালত জেনারেল এরশাদকে বেকসুর খালাস দিয়ে দেয়।
এ কেমন বিচার ব্যবস্থা!
নিম্ন আদালতে অযোগ্য জাজ নিয়োগ করে মানুষকে ভোগান্তির খেলা এখনও চলছে। আমার কাছে ভুড়ি ভুড়ি প্রমাণ রয়েছে নিম্ন আদালতের জাজরা অযোগ্য, অথর্ব, যুক্তিবুদ্ধিহীন রেফারেন্স মার্কা রায় প্রদানে অভ্যস্ত।
দেশের সর্বত্র অযোগ্যের দাপট!
আবার উচ্চ আদালতের বিচারপতিদেরও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে বা লোভী করে দিয়ে বিচার ব্যবস্থাটাকেই শেষ করে দেয়া হয়েছে। এখন অনায়াসেই জাজরা পয়সা খেয়ে রায় দেয়, বিচারপতিদের ঘুষ খাইয়ে যে-কোন রায় বদলে দেয়া যায়।
প্রদান বিচারপতি খায়রুল হক তার এক কলমের খোঁচায় আজ দেশটাকে ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে পৌছে দিয়েছেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অসুস্থ রায়ে রাষ্ট্রিয় হত্যাকান্ড চালিয়েছে বাংলাদেশ সরকার আবার সেই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সিনহাকেই এক লাথি মেরে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে- ধ্বংশ করে দেয়া হয়েছে দেশের বিবেককে।
বেগম জিয়াকেও আমরা দেখেছি নির্বাচনে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার আশায় বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে অসুস্থভাবে ক্ষমতা দখলের পায়তাড়া করতে। আমরা বেগম জিয়াকে দেখেছি ৯৬’এর ১৫ই ফেব্রুয়ারী অবৈধ নির্বাচন করতে। আমরা বেগম জিয়াকে দেখেছি বিচার বহির্ভূত ক্রস ফায়ারে হত্যাকান্ডের প্রচলন করতে; সেটা যত ভালো কাজেই হোক- অগ্রহনযোগ্য।
এভাবে একটা দেশকে অসভ্যতার নেতৃত্ব দিতে।
শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়ার বাতলে দেয়া পথ ধরে চলছেন মাত্র।
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়, সভ্যতাপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তাদের কারো অবদান বা দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। আর তাইতো জেনারেল এরশাদ আজ তাদের উপড়েই অবস্থান করছেন। আজ এরশাদকে খারাপ বলতে কষ্ট হয়, বিবেকে বাঁধে।
বেগম খালেদা জিয়া, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বা শেখ হাসিনা দেশের গণমানুষের উপর ভরষা করেন না, বিশ্বাস করে না; পরোয়াও করেন না সুতরাং তাদের মুল্যায়ন করারও কিছু নেই। ক্ষমতা দখলে রাখতে পুলিশ-ই আজ তাদের হাতিয়ার।
তারা গণতন্ত্র গণতন্ত্র করেন- কিন্তু গণতন্ত্র শব্দটির অর্থও হাসিনা-খালেদা-এরশাদ শিখেননি।
আজ কে মেয়র প্রার্থী হবে, কে এমপি প্রার্থী হবে, কে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা উপজেলা চেয়ারম্যান হবে- সেই সিদ্ধান্তও বের হয় হাসিনা-খালেদা-এরশাদের পকেট থেকে। এভাবে গণতন্ত্র হয় না।
শেখ হাসিনা ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনের আদলে ৫ই জানুয়ারী পাড় করেছেন।
শেখ হাসিনা বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর পরিবর্তে তাদের নপুংসক করে নিয়েছেন।
শেখ হাসিনা খুনী সন্ত্রাসীদের পরিবর্তে বিরোধীমতকে ক্রসফায়ারে দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা আদালতকে ব্যবহার করে বেগম জিয়াকে ৫ বছরের জেল দিয়েছেন।
সৌভাগ্য শেখ হাসিনার এটর্ণি জেনারেল মাহাবুবে আলম বা দুদকের আইনীজিবি সম্মান করে বেগম জিয়াকে ‘ইও ব্লাডি স্যাট-আপ’ বলেননি। মহিলা হিসাবে হয়তো সভ্যতা দেখিয়েছেন- বললেও কোন প্রতিবাদ হতো বলে আমি বিশ্বাস করি না।
আমি গেল বছর তারেক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে একটা আর্টিকেলে বলেছিলাম, বেগম জিয়ার জেল হবে- বৃদ্ধ বয়সে তাকে কস্ট দেবার প্রয়োজন দেখি না। আমি গত মাস দু’য়েক আগে বাংলাদেশের একজন নীতিনির্ধারনী ব্যক্তির থেকে পার্সোনালী কনফার্ম হয়েছিলাম বেগম জিয়ার কমপক্ষে ৫ বছরের জেল হবে।
বেগম জিয়ার কাছেও নিশ্চয়ই এই ‘সংবাদ’টি ছিল।
তিনি এখন জেলবন্দী। এটা কোন বিচার ছিল না।
এভাবে বিচার হয় না।
এই রায় শেখ হাসিনা বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে বিরোধী মতকে ফাঁসিতে ঝুলানোর ধারাবাহিকতা ছিল শুধুমাত্র।
তখনও প্রতিবাদ হয়নি, এখনও হচ্ছে না।
মুলতঃ প্রতিবাদ করে দেশের যুব সমাজ।
শেখ হাসিনা দেশের যুব সমাজকে অনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষা দেবার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আর শিক্ষার উপদেষ্টা জাফর ইকবালদের নেতৃত্বে।
দেশের আপামর যুব-জনগোষ্ঠী এখন আর মাঠে নামে না- কারণ আমি যা লিখলাম, সেটা তারাও জানে- বিশ্বাস করে।
দেশে ‘গণতন্ত্র’ আজ মৃত।
তারা জানেন বেগম জিয়া এসে গণতন্ত্রকে জীবিত করে দিয়ে যাবেন না।
তাহলে কেন মাঠে নামবেন?
বেগম জিয়া’র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম হলেও- ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত সুশিক্ষায় শিক্ষিত। তার ব্যক্তিত্ব, তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, তার কথা বলার ভংগি, তার চলাফেরা কথিত শিক্ষিত শেখ হাসিনার চেয়ে হাজারগুন উন্নত।
আর সেজন্যই, আমিসহ দেশের অনেক সাধারণ মানুষ তার জেল হওয়াতে কস্ট পাচ্ছে- মেনে নিতে পারছে না।
এটা হয়তো জিয়া পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা।
কিন্তু মানুষ আর পরিবারকেন্দ্রিক শাসনে ফেরত যেতে আগ্রহী নয় মোটেও।
দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, দেশে মানবাধিকার সবার উপরে স্থান পাবে; সভ্যতার শাসনের প্রতিযোগীতা সৃষ্টি হবে- সেই আশায় থাকে সাধারণ মানুষ।
আমাদের কি চিরজীবন আশাবাদী হয়েই থাকতে হবে?
গণমানুষের উপর ভরষা করে- এমন নেতৃত্ব কি আমারা দেখে যেতে পারবো না?