এনরমাল টিস্যূ


মানুষের শরীরে অসংখ্য টিস্যূ থাকে।
 
মানুষের মধ্যে যেমন কিছু মানুষ আছে পাগল বা এবনরমাল তেমনি কিছু টিস্যূ-ও থাকে যারা হয়ে যায় এবনরমাল। এই এনরমাল টিস্যূকেই সহজ ভাষায় বলা হয়ে থাকে টিউমর বা থাইরয়েড। এই টিউমরগুলিতে আবার ভিন্ন ভিন্ন কারণে দেখা দিতে পারে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ।
 
এক্ষেত্রে সবচে ঝুকির মধ্যে থাকে মেয়েরা।
 
অনেক মেয়েই ব্রেষ্ট টিউমরে ভোগে- লজ্জায় বা অসচেতনতায় অনেক সময় কারো সাথে শেয়ারও করতে চায়না। এবং ফলাফল বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই হতে পারে মারাত্মক।
 
আর আমাদের ঢাকা শহরে অধিকাংশ ডাক্তারই কিছু বুঝে বা না বুঝে প্রথম যে কাজটা করে ফেলে তা হলো- কয়েকটা পয়সার জন্য তার অদক্ষ হাতে অপারেশন করে টিউমরটি বাদ দিয়ে দেয়। এতে অধিকাংশ সময়ই সেই মেয়েটির কপালে নেমে আসে অনেক জটিল সমস্যা।
 
ব্রেষ্ট টিউমর ছাড়াও মানুষের শরীরে আরো অনেক জায়গায়ই টিউমর হতে পারে।
 
বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে অনেক মহিলাদের গলার বড় টিউমর দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলিকে আঞ্চলিক ভাষায় ঘ্যাঘ বা অন্যান্য নানা নামে ডাকা হয় এবং এর প্রধান কারণ হিসাবে- প্রকৃত কারণ না বুঝেই আয়োডিনের অভাবকেও দায়ী করে এদেশীয় ডাক্তারা।
 
বাংলাদেশের বিশেষতঃ ঢাকার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আমার অনেক বাস্তব এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার কিছু আজ শেয়ার করবো। সেই সাথে ইন্ডিয়া এবং আমেকিার কিছু তথ্যও শেয়ার করবো।
 
ঢাকায় আমার মা, আব্বাসহ অনেকের চিকিৎসার সাথেই আমি ওতপ্রতভাবে জড়িত ছিলাম- সেটা সরকারী বা বেসরকারী তথা অাধুনিক হসপিটালগুলিতেও; চিকিৎসার অসংখ্য ভুল যদি বাদও দেই কিন্তু নার্সসহ রিসিপ্টশনিষ্টদের অত্যন্ত বাজে, রুঢ় ও নোংড়া ব্যবহার ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
 
আমার মনে হয় সকলেরই এব্যাপারে বিস্তর তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকার কথা।
 
আমার শাশুড়ীর গলায় একটি বড় টিউমর দেখা দিল। তিনি ভোলা থাকতেন, ঢাকায় আসলেন আমার বাসায়। ঢাকার বিখ্যাত নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মাজেদ সাহেব দেখলেন।
 
তিনি কি দেখলেন- আমার মনে হয়েছে তিনি তা নিজেও বুঝেননি! আরেকজন ডাক্তারের রেফারেন্স লিখে দিলেন।
 
বুঝলাম, যা বোঝার।
 
এরপর গেলাম ল্যাব-এইড হসপিটালের আরেক বিখ্যাত নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডা. মঈনুল হাফিজ এর কাছে।
 
ভদ্রলোক আমেরিকায়ও পড়াশোনা করেছেন।
অত্যন্ত দরদ দিয়ে দেখলেন। কয়েকটা টেষ্ট করালেন।
ততদিনে আমার সাথে তার একটা ভালো বন্ধুত্ব সৃস্টি হয়েছে।
 
আমাকে ফোন করে জানালেন- টিউমরটা অপারেশন করতে হবে। এবং তিনি সেটা নিজেই করবেন। তবে, তিনি অপারেশনটা ধানমন্ডির কনসাস মেডিকেলে করাবেন।
 
একদিন ওনাকে ভর্তি করা হলো কনসাসে। রাত ৯টায় অপারেশন শুরু করবেন। আমার সিষ্টার-ইন-ল এর থেকে রক্ত নেয়াও হলো। ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো রোগীকে।
 
তারপর ঘন্টা খানেক পর বলা হলো, ‘সরি, এনাস্তানিয়ায় ঠিকমত কাজ হচ্ছে না, অপারেশন ক্যানসেল’।
 
আবার ডেট দেয়া হলো- এবার ল্যাব-এইড হসপিটালে।
দেড় লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে গেল অপারেশনে।
 
রোগী সুস্থ।
টিস্যূর এফএনএসি করা হলো- না কোন ক্যানসার নেই।
সুস্থ রোগী নিজে শহরে ফিরে গেলেন।
 
ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলো না।
 
মাস চারেক পর আবার বাম পাশে সেই একই মানের আরেকটি টিউমার আর আবির্ভাব ঘটলো।
 
আবার, ডাক্তার মঈনুল হাফিজ।
এবার তিনি কিছু ওষুধ দিলেন- কোন কাজ হলো না।
 
তারপর বললেন টিস্যূ নিয়ে এফএনএসি করাতে।
ঢাকার কোন এক ল্যাবে পাঠালেন টেষ্ট করতে।
 
৫/৬ দিন পর আমাকে ডা. মঈনুল হাফিজ ফোন করে জানালেন, ‘খবর ভালো না, ক্যান্সার হয়েছে।’
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘কেন হলো? কিভাবে হলো? আপনার অপারেশনে কি কোন প্রব্লেম ছিল?’
উনি বললেন, ‘না না, তা হবে কেন?’
আমি তাকে হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা শুনেছি বাংলাদেশে নাকি টেষ্ট রিপোর্ট অনেক ভূল হয়ে, এই রিপোর্ট ঠিক আছে তো?’
ডাক্তার মঈনুলের জবাব, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। ঠিক নাও হতে পারে! ঠিক আছে আমি অন্য ল্যাবে টেষ্ট করাবো আবার।’
 
তিনি অন্য ল্যাবে আবার টেস্ট করালেন।
এবং দেখা গেল- ক্যান্সার নেই!
 
এবার ডাক্তার মঈনুল ডিসিসান নিলেন, আবারও অপারেশন করাবেন।
আমি গেলাম ডাক্তার মঈনুল হাফেজের সাথে সরাসরি কথা বলতে। তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, আসলে ক্যান্সার নেই। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই টিউমরটাও অপরেশন করবো। কিন্তু অপারেশনের সময় আমি তাৎক্ষনাত একটি টিস্যু টেষ্ট করে দেখবো ক্যান্সার রয়েছে কিনা, যদি থাকে তাহলে অপারেশন করবো না। তখন আমি ক্যামোথেরাফি দিবো।’
 
আমি প্রচন্ড বিরক্ত হলাম।
 
অনেকটা চেচিয়ে বললাম, ‘আপনি গরু অর্ধেক জবাই করবেন, তারপর একটু মাংস খেয়ে দেখবেন মজা কিনা; মজা না হলে আবার সেলাই করে গরুকে তাজা করে ফেলবেন! আবার কেমো থেরাফীও আপনিই দিবেন? আপনি নাক-কান-গলা’র পর সার্জন এবং শেষে আবার কেমোথেরাফিষ্টও। খুব ভালো, কিন্তু এসব শিক্ষা কোথায় পেয়েছেন?’
 
ডা. মঈনুল কিছুটা বিব্রত, আমি এভাবে রিএ্যাক্ট করবো সে তা ভাবেনি। আমাকে শান্ত করে বললেন, ঠিক আছে আমি আরেকটা টেষ্ট করাবো ভিন্ন একটা ল্যাবে।
 
আমি বুঝে ফেললাম, ওনার দ্বারা চিকিৎসা হবে না।
ডাক্তার মঈনুল কে বললাম ঠিক আছে আপনি আরও টেষ্ট করুন।
 
আমি বাসায় ফিরে আমার শাশুরীর সমস্ত টেষ্ট রিপোর্ট নিয়ে স্ট্যাডি শুরু করলাম। কিছুই বুঝি না। দিন দুয়েক স্ট্যাডি করার পর কিছু বিষয় বুঝলাম; এটাও জানলাম ওটা কোন ঘ্যাঘ না শ্রেফ একটি এবনরমাল টিস্যু বা টিউমর এবং সুনির্দিষ্টভাবে এটার নাম ‘থাইরয়েড’।
 
তারপর কম্পিউটারে বসে টিউমর সম্পর্কে জ্ঞান নিলাম কিছু।
খুঁজে বের করলাম টিউমারের বিষয়ে এক্সপার্ট হসপিটাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম-ধাম।
 
গুছিয়ে একটা ই-মেইল রেডী করলাম, সাথে জুড়ে দিলাম গুরুত্বপূর্ণ টেষ্ট রিপোর্টগুলির স্কান কপি।
 
পরদিন থেকে আরেক অত্যাচারে জড়িয়ে গেলাম।
 
ভারতের অধিকাংশ লোকই টাওট, সেটা আমি জানি। তো, সেই দেশের অনেক নাম করা হসপিটাল গুলি থেকে ফোন আসতে শুরু করলো আমার মোবাইলে। সবাই ফোন করে বললো, এটা কোন সমস্যাই না। আপনি ২০,০০০ ডলার নিয়ে চলে আসুন আমাদের হসপিটালে, আমরা সব ব্যবস্থা করে ওয়াল্ড ক্লাস ট্রিটমেন্ট দিবো। রোগীর পাসপোর্ট কপি পাঠান ইনভাইটেশন লেটার দিয়ে দিচ্ছি।
 
মুম্বই এর টাকা মেমোরিয়াল থেকে শুরু করে দিল্লীসহ সাউথ ইন্ডিয়ান বিভিন্ন নাম করা হটপিটালের অনেক ইমেইল ও মোবাইল কল রিসিভ করলাম।
 
আমি রীতিমতো হতাশ এবং বিরক্ত।
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি।
 
কিন্তু আমি আশাবাদী।
আমি ধের্য্য ধারণ করতে জানি।
এবং বিশ্বাস করি কেউ না কেউ আমার ইমেইল এর পারফেক্ট জবাব দিবেই।
 
এবং ঠিক ৩/৪ দিন পর একটা চমৎকার ই-মেইল পেলাম।
আমি এই ই-মেইলটার জন্যই মূলতঃ অপক্ষোয় ছিলাম।
 
উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষৌ’র কিং জর্জ মেডিকেল হসপিটালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ব্রেষ্ট ক্যান্সার জেনারেল সার্জারী ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডা. আনন্দ মিশ্রা আমাকে ইমেইলটি করেছেন।
 
অত্যন্ত সংক্ষেপে তিনি বলেছেন, ‘আমি তোমার ই-মেইলটি খুব ভালো করে দেখেছি। বিষয়টা আমার কাছে জটিল মনে হয়েছে। কিন্তু আমার হসপিটালে এর ট্রিটমেন্ট রয়েছে। তুমি রোগীকে নিয়ে চলে আসো। এটা ১০০ বছরের পুরাতন সরকারী হসপিটাল এবং এখানে চিকিৎসা সম্পূর্ণ ফ্রি। তুমি ৩০/৩৫ হাজার রুপি নিয়ে আসলেই চিকিৎসা করাতে পারবে। সবচে বড় কথা এই ভারতবর্ষে একমাত্র আমাদের হসপিটালেই শুধুমাত্র ‘এবনরমাল টিউমর’ নিয়ে গবেষনা করা হয়।’
 
আমি উৎসাহ পেলাম।
ভদ্রলোকের সাথে কয়েকটি ই-মেইল চালাচালি করলাম।
ওনার হসপিটাল সম্পর্কে ইন্টারনেটে জানলাম।
 
হসপিটালটির নতুন নাম ‘ছত্রপতি সাহুজি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’ যা মূলত এখনও কিং জর্জ নামেই বেশী পরিচিত।
 
আমার বাসায় মিটিং বসলো আমার শ্বশুরবাড়ীর লোকদের নিয়ে। সেখানে তৎকালীন এমপি তোফায়েল আহমেদও উপস্থিত ছিলেন; যিনি এখন বাণিজ্য মন্ত্রী। ভদ্রলোক আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন। তিনি সব জেনে তার মতামত দিলেন, আমার হাতে ৭০০ ডলার দিয়ে তোফায়েল মামা বললেন, তুমি যেটা ভাল বুঝ করো; আমার পূর্ণ আস্থা ও সম্মতি রয়েছে তোমার কাজে।
 
অন্যরাও আমার উপর দায়িত্ব দিতে চাচ্ছেন।
কিন্তু আমি বাঙালী মানসিকতা আমি জানি।
 
তাই সরাসরি সবাইকে স্পস্টভাবে বলে দিলাম, ‘রোগীর দায়িত্ব আমি নিচ্ছি- ভাল বা খারাপ যেটা-ই হোক; আমাকে কেউ কোন কথা বলতে পারবেন না।’
তোফায়েল মামা বিশেষ ব্যবস্থায় ১ দিনের মধ্যেই ইন্ডিয়ান ভিসা করে দিলেন। বলতে দিধা নেই আমি বাংলাদেশী নেতাদের মধ্যে একমাত্র তোফায়েল আহমেদকেই দেখেছি মানুষকে নগদ টাকা দিয়ে সাহায্য করতে। অন্যদের দেখেছি শুধু চায়, দিতে শিখেনি।
 
লক্ষৌ’র বিখ্যাত কিং জর্জ হসপিটালের গেটে একজনকে ‘ডা. আনন্দ মিশ্রা’ সম্পর্কে জানতে চাইলে তার মুখ দেখেই বুঝে ফেললাম তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন মানুষ এই হসপিটালে।
 
আজ তিনি ওপিডি-তে রোগী দেখছেন।
আমি তাকে একটা টেক্সট করে সরাসরি ওপিডি রুমে গেলাম।
 
অসংখ্য রোগী সেখানে।
তিমি আমাকে দেখে একটা মৃদু হাসি দিয়ে হাতের ঈশারায় বসতে বললেন এবং একজন পিওন কে বললেন আমাদেরকে পানি দিয়ে আপ্যায়ন করতে বললেন। ওনি প্রচুর পান খান।
 
ভারত বর্ষের এই বিষয়টা আমার খুব পছন্দ।
যে কাউকে এরা প্রথম এক গ্লাস পানি দিয়ে আপ্যায়ন করে।
 
আমরা বসলাম।
ডা. আনন্দ যতটা সম্ভব দ্রুত আমাদের কাছে আসলেন।
 
অামার সাথে হাত মিলিয়েই সরাসরি রোগীর গলায় হাত দিলেন। কিসব দেখলেন। নিজের মতো করো বুঝলেন বিষয়টা। একটু সময় নিলেন।
 
তারপর আমাকে বললেন, ‘আমি আশঙ্খা করছি ওনার রোগটার নাম ‘থাইরয়েড লিমফোমা। এটা এক ধরণের রেয়ার ক্যান্সার। তবে নিরাময়যোগ্য। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এটা যদি সত্যিই থাইরয়েড লিমফোমা হয়ে থাকে, তাহলে তিনি হবেন ভারতবর্ষের ৮ম রোগী। এবং সরাসরি আমার হাতের তৃতীয় রোগী। অাগের দু’জন রোগীই এখন সুস্থ। কিন্তু এটাকে অপারেশন করিয়েছেন কেন? ভুল করেছেন- যেটা থাইরয়েড লিমফোমা’র জন্য অত্যন্ত ক্ষতির কারণ। যা-ই হোক এটা সম্পূর্ণ আমার অনুমান নির্ভর বক্তব্য। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। আমি কয়েকটা টেষ্ট করাবো নিশ্চিত হবার জন্য।’
 
এরপর ওনি ওনার চেম্বারে নিয়ে গেলেন আমাদের।
আমার শ্বাশুরী বললেন তাকে ঢাকাতে অনেক কস্ট পেতে হয়েছে এফএনএসি (বায়াপসী) করার জন্য- টিস্যু নেবার সময়।
 
আমি বিষয়টা ডা. আনন্দকে জানালাম, রোগীর ভয়ের কথা।
ডা. আনন্দ অাতকে উঠলেন! কেন কস্ট হবে কেন?
 
এরপর তিনি নিজেই একটা বড় সিরিঞ্জ আনিয়ে টিস্যূ বের করে নিলেন- রোগী কোন ব্যাথাই পেলেন না।
 
টিস্যূ টা দিয়ে আমাকে পাঠালেন আরেকজন ল্যাব এক্সপার্ট এর কাছে; তিনি ষাটউর্ধ একজন ভদ্রমহিলা।
 
ড. ভিনি টেনডন, গোমতী নগরে ওনার বাসা কাম ল্যাব।
অবিবাহিতা চমৎকার একজন মানুষ তিনি, ভিষন চটপটে ও ভদ্র।
 
আমার সাথে খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেল মুহুর্তেই। তিনি ৫দিন সময় নিলেন রিপোর্ট তৈরীর জন্য। বাংলাদেশ শুনে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ডা. আনন্দ মিশ্রার ভূয়সী প্রসংসা করলেন আমার কাছে। আরো কয়েকটা টেষ্ট করালাম অন্য একটি ডায়াগনষ্টিক এ; সংগে সংগেই রিপোর্ট দিয়ে দিল আমাদের।
 
পাঁচ দিন পর ড. ভিনি টেন্ডন রিপোর্ট দিলেন এবং আমাকে গোপনে জানালেন থাইরয়েড লিমফোমা।
 
ডা. আনন্দ রিপোর্টগুলি দেখে জানালেন, তার আশঙ্খাই সত্যি। এটা থাইরয়েড লিমফোমা।
 
আমি জানতে চাইলাম তাহলে চিকিৎসা শুরু করে দেন। কি করতে হবে? ক্যামো দিতে হবে কিনা? ইত্যাদি।
 
তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘আমি তো টিউমর এর চিকিৎসক। আমি কিভাবে ট্রিটমেন্ট দেবো। আমার কাজ টিউমর নিয়ে।’
 
আমি তো বোকা হয়ে গেলাম।
ডা. মঈনল হাফিজের কথা মনে হলো- তিনি একাই, নাক-কান-গলা-সার্জন-কেমো ইত্যাদি সবকিছু!
 
ডা. আনন্দ রেফার্ড করে দিলেন এই হসপিটালেরই আরেকজন অতি বিখ্যাত ডাক্তার ক্যাপ্টেন এমএলবি ভাট যিনি রেডিওথেরাফি ডিপার্টমেন্টের হেড।
 
খুবই ব্যস্ত মানুষ।
ষাট বছর বয়স তো হবেই।
 
যখন জানলেন আমি বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি- চমৎকার অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের।
 
তিনি রিপোর্ট দেখলেন, ফোনে ডা. আনন্দ এর সাথে কথা বললেন, রোগীর কেমো নিতে পারবে কিনা তার জন্য কয়েকটা টেষ্ট দিলেন।
 
তারপর সব বুঝে নিয়ে ক্যামো-থেরাফি দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমাকে বললেন ৬টা কেমো দিতে হবে ২১ দিন পরপর। প্রথম কেমো দেবার পর রেডিওথেরাফি দিতে হবে। রোগীকে ৩/৪ মাস এখানে থাকতে হবে- ওনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।
 
কিন্তু কে থাকবে ৩/৪ মাস।
১০ দিনেই আমার ব্যবসায় লালবাতি!
 
কেমো থেরাফির দাম পড়লো ৩৮৭ রুপি।
আর বেড চার্জ ৩০ রুপি। কেমো হয়ে গেল।
 
কমপাউন্ডার আশিষ মিশ্রাকে বখশিস দিতে গেলাম। সে টাকা ধরলোই না। ‘আমি হসপিটাল থেকে যথেষ্ঠ টাকা বেতন পাই। স্ত্রী সন্তান নিয়ে খুব ভালো আছি। আমার জন্য বারতি টাকা হারাম। আমি নিতে পারবো না।’
 
আমি আশিষ এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম মিনিট পাচেক। আর ভাবলাম অতি সভ্য দেশ- বাংলাদেশের কথা! বাংলাদেশের ব্যবহারের কথা! মনে মনে বাংলাদেশ কে ধন্যি ধন্যি দিলাম!!!
 
যাই হোক, পরবর্তীতে এই রোগীকে নিয়ে আরও প্রায় ১২/১৩ বার লক্ষৌতে যেতে হয়েছে বিক্ষিপ্ত ভাবে।
 
ডাক্তারের কথা মতো ট্রিটমেন্ট করা সম্ভব হয়নি।
পাঁচ বছর পর রোগী মারা যান।
 
মারা যাবার আগেরদিন ইমেইলে ডা. এমএলবি ভাটের পরামর্শে ঢাকার কয়েকটা টেষ্ট রিপোর্ট ইমেইল করে পাঠিয়েছিলাম।
তিনি আমাকে রিপ্লে দিয়েছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে দয়া ভিক্ষা করো’।
পরদিন তিনি মারা যান।
 
ডা. আনন্দ মিশ্রা এবং ডা. এমএলবি ভাট নিঃসন্দেহে আমার দেখা পৃথিবীর অন্যতম সেরা চিকিৎসক। আমি অত্যন্ত গর্বিত তারা দু’জনই আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। আমার সাথে নিয়মিত ট্রেক্টট ম্যাসেজ, ইমেইল, হোয়াটসআপ এ যোগাযোগ হয়।
 
ডা. ভাট ২০১৪ সালে একবার কোলকাতা এসেছিলেন একটা কাজে। ওনার ধারণা ছিল কোলকাতা আর বাংলাদেশ হয়তো একই বা ভারত নেপালের মতো। আমাকে বেশ কয়েকটা ইমেল ও টেক্সট করেছিলেন তার সাতে যেন কোলকাতায় তার হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি।
 
ডা. আনন্দকে দেখেছি তিনি কোন টিওমররে অপারেশন করতে চাইতেন না; সেটা মেয়েদের ব্রেষ্ট টিওমর হলেতো করতেই চাইতেন না। ওষুধ দিয়ে সাড়িয়ে তুলতেন।
 
একান্ত বাধ্য না হলে তিনি অপারেশন করেন না।
 
সারা ভারত থেকে অসংখ্য রোগী এই বিখ্যাত ডাক্তারের কাছে যায় চিকিৎসা পাবার আশায়।
 
আমি ওই দু’জন ডাক্তারের বাসায় গিয়েছি বেশ কয়েকবার। বেড়াতে, রোগী নিয়েও। ডাক্তার এমএলবি ভাট বাংলাদেশের শাড়ীর খুব ভক্ত; প্রতিবারই তার স্ত্রীর জন্য শাড়ী নিয়ে যেতাম; না নিলে বলতেন ‘শাড়ী কোথায়?’।
 
আর ডা. আন্দদের জন্য নিতাম ঢাকা থেকে টাই। তিনি পাগল টাই’এর।
 
ডা. আনন্দ কয়েকমাস আগে নিউ ইয়র্ক বেড়িয়ে গেলেন।
পুরো আমেরিকা থেকে অনেকগুলি কাজের স্বীকৃতি ও গবেষনার সনদ নিয়ে গেলন। ডা. আনন্দ (Anand Mishra) ফেসবুক ব্যবহার করেন। নিয়মিত কথা হয় আমাদের। অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান পুরুষ তিনি।
 
কতগুলি গুণ থাকতে হয় একজন ডাক্তারের সেটা আমি ভারতে দেখেছি। বাংলাদেশের ডাক্তারদের অনেকে কসাই বলে; ভূল বলে না।
 
কিন্তু আমার চিন্তায় অন্য জায়গায়। ঢাকায় হাতে গোনা কয়েকজন খুব ভালো চিকৎসক রয়েছেন; এরা মারা যাবার পর কি হবে?
 
বাংলাদেশের কোন সেক্টরটা পরিপাটি?
কোথায় একজন সৎ, সুস্থ, সভ্য মানুষ পাওয়া যায় বাংলাদেশে?
 
যে-কোন দেশের ক্যান্সার রোগীদের জন্য ভারতীয় রেলওয়েতে ভ্রমণে কোন ভাড়া দিতে হয় না। ফ্রি টিকেট সংগ্রহ করতে হয়।
 
ঢাকার ইন্ডিয়ান এম্বাসী অতি দ্রুত মেডিকেল ভিসা প্রদান করে থাকে; মাল্টিপলও দিয়ে দেয়। অবশ্য আমার সাথে একটু ঝামেলা করতো; কারণ আমার পাসপোর্টে অসংখ্য ভারতীয় ভিসা, পাকিস্তানের ভিসা, সার্ক ভিসা এবং সর্বপরি ইসলামী ব্যাংকের ষ্টেটমেন্ট। কিন্তু ঝামেলা করেও কুলিয়ে উঠতে পারতো না, মামা আছে না!
 
সরকারী হসপিটালটিতে ১ রুপি ভিজিট দিতে হয় ওপিডিতে রোগী দেখাতে।
আমার শাশুড়ীকে দামী কেমোও নিতে হয়েছে শেষ দিকে অনিয়মিত হবার কারণে।
 
মজার বিষয় হলো এই ডা. এমএলবি ভাট ১টি কেমো আমাদের ফ্রি দেবার জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন যার মূল্য ৪৫,০০০ রুপি; ডা. ভাট আমাদের কোন কিছুই হন না। তিনি ওই কোম্পানীর রিপেজেনটেটিভকে বলে দিয়েছিলেন, ফ্রি ক্যামো দিতে; ডাক্তারের কথাকে অসম্মান করেননি তিনি।
 
কিন্তু সেই ফ্রি কেমোটি আর নেয়া হয়ে উঠেনি।
 
ডা. আনন্দ আমাকে তার বিভাগীয় প্রধান তথা হসপিটালের ভিসির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এটা বোঝাতে যে, আমরা ভিন দেশ থেকে এসেছি বলে রোগীর চিকৎসায় কোন গাফিলতি হবে না; আমরা যেন তাদের উপর ভরষা রাখি।
 
ভিসি মহোদয় নিজে আমাকে আস্বস্ত করেছিলেন চিকিৎসা শুরু আগে।
 
আমার কয়েকজন ফ্রেন্ড আমার রেফারেন্স ওই হসপিটাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন; তারাও মুগধ।
 
৪৭’র পর আমরা আলাদা হয়েছি।
অথচ একটা দেশে শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়- নেপাল, ভুটান, মালদিভস, পাকিস্তান, মধ্য ইওরোপ এমনকি আফ্রিকা থেকেও মানুষ লাইন ধরে আসে ‘চিকিৎসা’ করাতে।
 
আর আমরা?
আমরা কথায় কথায় ভারতকে গালাগালি করে নিজেদের মহৎ ও মহান দেশপ্রেমিক সাজাই।
 
পুরাতন পোষ্ট থেকে-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *