একটি বন্য গল্প


একটি ‘ওয়াইল্ড স্টাফ’ বা বন্য গল্প বলি।
 
অভিযোগ রয়েছে যে, ২০১৩ সালে মস্কো সফরের সময় রুশ পতিতাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এছাড়া তিনি মস্কোর একটি হোটেলের একটি নির্দিষ্ট বিছানায় পতিতাদের দিয়ে মূত্রত্যাগ করিয়েছিলেন; কারণ রাশিয়া সফরকালে বারাক ওবামা ও তাঁর স্ত্রী হোটেল রিৎজ-কার্লটনের প্রেসিডেন্ট স্যুইটে অবস্থান করেছিলেন।
 
অন্য আরেকটি অভিযোগ ছিল, রুশ গোয়েন্দারা আমেরিকার ভাবি প্রেসিডেন্টকে ব্ল্যাকমেইল করবেন বলে তার এসব র্কীতি ভিডিও করেছিলেন।
 
তৎকালিন এফবিআই প্রধান পরিচালক এবং পরবর্তীতে চাকুরীচুত্য উইলিয়াম কোমি তার বইতে লিখেছেন যে- এ বিষয়ে পরিচালক ক্লাপার যুক্তি দিলেন, ‘তার অনুমান মিডিয়া এসব বিষয় জেনে গেছে’, এবং তারা যেহেতু রিপোর্ট করতে যাচ্ছে। তাই আমরা গোয়েন্দারা এই সিদ্ধান্তে পৌছলাম যে, বিষয়টি আমেরিকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে জানানো উচিত।
 
প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে বিষয়টি তোলার পর তিনি কোনোই প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তবে পরিমিত কন্ঠে তিনি (প্রেসিডেন্ট ওবামা) জানতে চাইলেন, ‘তাহলে আপনারা তাকে ব্রিফ করার বিষয়ে কি পরিকল্পনা করেছেন?’
 
পরিচালক ক্লাপার ত্বরিত একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, পরিচালক কোমি এ বিষয়ে একা প্রেসিডেন্ট-ইলেক্টের (ডোনাল্ড ট্রাম্প) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তুলে ধরবেন।
 
এফবিআই প্রধান পরিচালক উইলিয়াম কোমি এরপর লিখেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা একটি শব্দও বললেন না। তিনি তার মাথাটি বাঁ দিকে কাত করলেন। এবং সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। তার দুই ভ্রু নেচে উঠল। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তবে আমার মনে হল, তিনি একইসঙ্গে কৌতূক এবং উদ্বেগ বোধ করছেন। তার অভিব্যক্তিতে যেন এটাই ফুটে উঠেছে যে, “আচ্ছা, গুড লাক তবে আপনাদের।”
 
এই ‘বন্য-গল্প’ এজন্য বললাম যে, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কত বড় একজন মানুষ ছিলেন- সেটা দেখাতে। আমাদের বাংলাদেশ হলে শেখ হাসিনা বা মতিয়া চৌধুরীরা রসিয়ে রসিয়ে কি বলতেন, বা বলতে পারতেন- সেটা একটু ভেবে দেখবেন।
 
গল্পটার পেছনে আরও কিছু কথা বলা যেতে পারে।
জন রিভস আমার বন্ধু। ও হোয়াইট আমেরিকান। ওর জন্ম আমেরিকার আলাবামা ষ্টেটে- যেখানে ওর প্রায় ৪ পুরুষ বংশানুক্রমে বসবাস করছে আসছে; যদিও জন রিভস নিউ ইয়র্কে বসবাস করেন। রিভসের ওয়াইফ হাউজ ওয়াইফ।
 
রিভস প্রথম যখন আমাকে বললেন যে, তার স্ত্রী একজন হাউজ ওয়াইফ এবং জীবনে কোনদিন চাকুরী করেনি, আমি যথেষ্ঠ অবাক হয়েছিলাম- আসলে এমনটা আমেরিকায় বিরল।
 
রিভসের অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা ভাল না।
এটা সে আমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দেয়। অনেকটা হতাশার স্বরে সে কথাগুলি বলে। অত্যন্ত সাধাসিধে জন রিভস প্রায়ই সন্ধ্যায় চলে আসে আমার অফিসে। গল্প করি, আড্ডা দিই। ও মিথ্যা কি জিনিস সেটা জানে না, বুঝেও না।
 
অনেক সময় রিভসের উপস্থিতিতে আমার কাছে ক্লায়েন্ট চলে আসে। মাঝেমধ্যে অনেক ক্লায়েন্টকে আমি রিভসের সংগে পরিচয় করিয়ে দিই। ওহ বলিনি তো যে, জন রিভস একজন ইমিগ্রেশন এটর্ণী।
 
একদিন আমার একজন ক্লায়েন্ট কথা বলতে বলতে সুযোগ পেয়ে এটর্ণী রিভসের কাছে কোন একজন বাংলাদেশী-আমেরিকান এটর্ণীর বিরুদ্ধে কিছু সমালোচনা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু শুরুতেই রিভস তাকে বাঁধা দিলো এবং আমাকে অনুরোধ করলো ‘তার সামনে যেন কেউ কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা না করে’।
 
আসলেই আমেরিকান সমাজে এসব বেমানান।
অসুস্থ মনের কোন মানুষ আমেরিকাতে নেই- সেটা বলছি না। সব জায়গাতেই ভালো-মন্দ দুই-ই থাকে। সংখ্যার তারতম্য হয় মাত্র। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নৈতিকতাবিবর্জিত ব্যক্তিও আমেরিকার মতো দেশে প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন।
 
কিন্তু তারপরও আপনি এই ভুখন্ডে পা না দিলে কোনভাবেই বুঝতে পারবেন না যে এরা কি মাপের মানুষ। একটা সমাজ, একটা দেশ কিভাবে এতটা সুসভ্য হতে পারে- সেটা রীতিমত গবেষনার বিষয়।
 
খুব ছোট বেলা থেকেই আমার আমেরিকার প্রতি ঝোঁক, সেটা তো সবাই জানে। আমি তখন কলেজ ষ্টুডেন্ট। আমার এক ভাতিজা বাংলাদেশে বেড়াতে এলো আমেরিকা থেকে। সে বছর কয়েক হবে আমেরিকায় প্রবাসী হয়েছে তার পিতা-মাতার সংগে ওপি-১ লটারী পেয়ে।
 
রাতে আমি আর আমার সেই ভাতিজা এক সংগে আমার খাটে ঘুমুতে গেলাম, ও আমারচে হয়তো বছর কয়েক ছোট হবে। আমি আমেরিকানরা কেমন জানতে চাইলাম। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম তার প্রথম কথাটাই ছিল, ‘কাকা, বিশ্বাস করবেন না- সামার এলে তো আমেরিকার মেয়েরা শরীরে জামা-কাপড়ই রাখতে চায় না’।
 
বিষয়টা সত্যিই আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল; আমার চিন্তাটাও ওভাবেই গড়ে উঠেছিল।
 
আমি আজ প্রায় চার বছর আমেরিকায় রয়েছি।
সত্যি বলছি- চারটা সামার পার করছি আমি। না, আমি আমেরিকায় একটা মেয়েও দেখেনি যে কি না সামারে নিজের শরীরে জামা-কাপড় রাখতে চায় না।
 
আমি বুঝতে পারি, আসল সমস্যাটা আমাদের দেশের মানুষদের চোখে। এই জাতির চোখ জামা-কাপড় ছাড়া মেয়ে মানুষ দেখতে হন্যে কুকুর হয়ে থাকে। সুতরাং তারা তো তাই-ই দেখবে!
 
আমি বলছি, আমার বিগত চার বছরের অভিজ্ঞতায়- আমেরিকানরা জামা-কাপড় ছাড়া থাকে না। হ্যাঁ ওরা অতিরিক্ত গরমে হালকা পাতলা জামা-কাপড় ঠিকই, কিছু কালো ও স্পেনিশ মেয়েতে কিছুটা উগ্রতা দেখাও যায় সত্য কিন্তু ওরকম উগ্রতা আপনি ঢাকা শহরে অহরহ দেখছেন; আমিও দেখেছি।
 
এবং সবিনয়ে বলছি সাদা জাতের আমেরিকান মেয়েদের পোষাক, পোষাকের রুচি জ্ঞান আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। এদেশের সাদা মেয়েরা ম্যাক্সিমাম সময়ই অত্যন্ত মার্জিত ‘এক কালারের’ দামী পোষাক পরে। সাদা ছেলেরা কখনওই উগ্র বা ছেড়া ফাঁটা জিনস প্যান্ট পরে না। এবং সামারে সাদারা সবসময় পাতলা কাপড়ের প্যান্ট পরে। এদের সার্ট, টি-শার্ট, প্যান্ট দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে নিজের রুচি বৃদ্ধি করার জন্য।
 
অবশ্য এদেশে কেউ কারো দিকে তাকায় না।
আর কোন মেয়ের দিকে কোন পুরুষ তো ভুলেও তাকায় না।
‘একটা মেয়ে কি পোষাক পরেছে’ বা ‘তাকে দেখতে কেমন দেখাচ্ছে’ এরকম ‘বাংলাদেশী অসভ্যতা’ আমেরিকায় নেই।
 
‘এদেশে পাবলিক বাস-ট্রেনে কে কাকে নিজের সিট ছেড়ে বসতে দিবে’ সেই প্রতিযোগীতা চলে। এদের মুখে হাসি ফুটেই থাকে কথা বলার সময়। অপরিচিত কাউকেও দেখলে ‘হাই, হাও আর ইও ডুয়িং’ এই কমন বাক্যটি ফুটবেই। কেউ এখানে খাবার খেয়ে খোসাটি রাস্তায় ফেলে দেয় না, নিজের ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখে এবং পরবর্তীতে ডাষ্টবিনে নিক্ষেপ করে।
 
আমার ভাতিজা আমাকে এসব বলতে পারেনি কোনদিনও; হয়তো সে এসব দেখে-ই নি কোনদিন।
 
দেখতে যে সুসভ্য একজোড়া চোখ লাগে!
বাঙালীর কি সেই সুসভ্য চোখ আছে?
 
হ্যা, আমেরিকায় ‘আমাদের বাংলাদেশী চোখে’ সবচে খারাপ যে দৃশ্যটি দেখা যায় হরহামেশা সেটা হলো রাস্তা-ঘাটে-বাসে-ট্রেনে সবজায়গাতেই এখানকার ছেলে-মেয়েরা (বাস্তবে শুধুমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকারা) পরস্পরকে চুম্বন করে। কিছু উগ্রতা দেখা যায় যাদের এই চুম্বন ‘লিপ-কিস’ এ পরিণত হয়- ব্যস এরচে বেশী কিছু না। এবং এই ‘এরা’ও কিছু স্পেনিশ ও কালোদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমি আজ পর্যন্ত একজন হোয়াইট আমেরিকানের আচরণে এতটুকু উগ্রতাও দেখিনি।
 
‘প্রেমিক-প্রেমিকাকে চুমু খাবে’ এটা আমেরিকার অতি সাধারণ কালচার- এখানে নোংড়ামীর কিছু নেই। এদেশ এভাবেই গড়ে উঠেছে- এখানে এটা অত্যন্ত সাধারণ বিষয়।
 
যাই হোক, বলছিলাম আমার বন্ধু জন রিভসের কথা।
এটর্ণী জন রিভস ও আমি মিলে একটা রিয়েল এষ্টেট কোম্পানী করেছি। রিভসের জন্য ভিজিটি কার্ড বানাবো। ওকে বললাম তোমার কার্ডে তোমার পদবী কি লিখবো। সে সরাসরি বলল কেন? লিখবে ‘ব্রোকার’।
 
আমার বাংলাদেশী মনে ‘ব্রোকার’ শব্দটি কেমন কেমন যেন লাগছিল! তাই ওকে বললাম, “তারচে ‘রিয়েল এষ্টেট ব্রোকার’ লিখলে ভালো দেখায় না?”
রিভসের তাৎক্ষনাত উত্তর, ‘কেন? শুধু ব্রোকার-ই তো ভালো। আমি তো ব্রোকার হিসাবেই কাজ করবো।’
 
এই জন রিভসকে একদিন বললাম তোমাকে আজ বাংলাদেশী খাবার খাওয়াবো- খাবে?
সে তো মহাখুশী। স্পাইসি খাবার নাকি তার খুবই পছন্দ।
 
আমি তাকে নিয়ে গেলাম একটা বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টে, ডিনার করাবো।
 
আমার চিন্তা ওকে রিয়েল বাংলাদেশী ডিশ খাওয়াবো।
সুতরাং ভাতের সংগে নান এবং কয়েক রকমের ভর্তা, শাক ভাজি, ছোট কাচকী মাছ, তরকারী দিয়ে ইলিশ মাছ, বড় চিংড়ী মাছ ভুনা, গরুর মাংস ইত্যাদি আরও যেন কি কি অর্ডার দিলাম।
 
বন্ধু রিভস আমার একটি স্পোন, একটি ফ্রর্ক আর একটি নাইফ নিয়ে তার খাবার শুরু করলেন। আমি হেসে দিয়ে ওকে বললাম, ‘এভাবে তো তুমি বাংলাদেশী খাবার খেতে পারবে না। তোমাকে ওসব ফেলে দিয়ে বাংলাদেশী স্ট্যাইলে খাবার খেতে হবে; নইলে কোন মজাই তুমি পাবে না’।
 
ও প্রশ্ন করলো, ‘সেটা কিভাবে?’
আমি বললাম, ওসব ফেলে দাও। সরাসরি হাত দিয়ে খাবে। বলেই আমি নিজে হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু বেচারা রিভস কি আর পারে!
 
সে যা করলো তা ছিল অনেকটা এরকম যে- দুই হাত দিয়ে রীতিমত যুদ্ধ করার মতো। একবার ডান হাত দিয়ে ইলিশ মাছ নেয়, টিস্যু দিয়ে কাটা (বনস) টেনে টেবিলে ফেলে, আবার বা হাত দিয়ে একটু চিংড়ী মাছ নিয়ে মুখে দেয়। একটু নান ছিড়ে খায় সংগে নেয় ভাত। এরপর আবার দেখা গেল বা হাত দিয়ে কিছু ছোট মাছ মুখে দিতে! আমি ওকে বাঁধা দিই নি- খাকনা ফ্রি স্টাইলে একদিন বাংলাদেশী খাবার।
 
শেষটায় রিভসের আরেকটা গল্প বলে বিদেয় নিবো আজ।
আমার একজন ক্লায়েন্ট- একটা বাংলাদেশী মেয়ে তার হাজবেন্ডের গ্রীনকার্ডের জন্য আবেদন করেছে- হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কিছু পূর্বাপর ঘটনার জন্য ওকে সাসপেক্ট করেছে। মেয়েটা ভীষন ভয় পেয়েছিল; যাই হোক রিভসের সহযোগীতায় সমস্যা উৎরানো গেছে। তো, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবার মেয়েটির কাছে তার বিয়েটা যে সামাজিক ভাবে হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ‘বাস্তবিকই ভালো সম্পর্ক’ (গুড ফেইথ) রয়েছে তার কিছু প্রমাণ-পত্র দিতে বলেছে।
 
রিভস ওভাবেই মেয়েটিকে এডভাইস করেছে এবং সংগে তাদের বিয়ে ও বিয়ে-উত্তর-হানিমুন এর কিছু ছবি দিতে বলেছে। সেমতেই মেয়েটা গোটা একটা এ্যালবাম নিয়ে এসেছে। আমি ওখান থেকে গোটা বিশেক ছবি বাছাই করেছি।
 
রিভস আসলো আমার অফিসে, আমি ওকে ওই ছবিগুলি বের করে দেখালাম। তার মধ্যে কয়েকটা ছবি ছিল যেখানে মেয়েটা এবং তার হাজবেন্ড সমুদ্র সৈকতে গোসল করছে। এবং বাংলাদেশী ছেলে মেয়েরা তো সাধারণ জামা-কাপড় পরেই সমুদ্র-স্নান করে!
 
কিন্তু রিভসের ‘আমেরিকান চোখ’- সেটা মানবে কেন!
সে আমাকে প্রশ্ন করলো, ‘হেই! এরা জামা-কাপড় পরে সাগরে নেমেছে কেন? এভাবে বেড়াতে যাবার ড্রেস পরে কি কেউ সাগরে গোসল করতে পারে!’
 
যাই হোক, অনেক কষ্টে আমি রিভসকে বুঝিয়েছিলাম বিষয়টা।
 
আমি কিন্তু একবারও বলছি না যে, “ঢাকায় সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া সেই ‘ওপেন কিস’ এর ছবির পক্ষের ‘তথাকথিত আধুনিক মানুষ’গুলি পশ্চিমাদের শুধু কিস করাটুকুই শিখেছে- কিন্তু তাদের বাদবাকী সভ্যতার দিকে একটি বারের জন্যও তাকাবার সময় পায়নি!”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *