আমার বাবা’র কথা


ওয়ানে ভর্তি হয়েছি।

আমাদের বাড়ী আউলিয়াবাদ গ্রামে আর স্কুল হাসনাবাদ গ্রামের দুরত্ব কমবেশী ১ মাইল।
গ্রামের কয়েকজন কাছের চাচাতো ভাই’য়েরা একসাথে স্কুলে যাই সকাল সোয়া দশটায় ক্লাস শুরু হয়ে শেষ হয় সাড়ে তিনটায়, মাঝ খানে তিনবার টিফিন ব্রেক।

আমাদের প্রাইমারী স্কুলটা অনেকটা বান্দুরা হলিক্রস হাইস্কুলের অলিখিত প্রাইমেরী ভার্সন। বান্দুরা হলিক্রসে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হতে- ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে হয় কিন্তু হাসনাবাদ প্রাইমেরী স্কুলের ছাত্রদের কোন ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি নেয়া হত।

এই হাসনাবাদ প্রাইমেরী স্কুল এবং বান্দুরা হলিক্রশ হাই স্কুলের বেশীরভাগ শিক্ষকই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, এর পরের সংখ্যাধিক্ষ্য যথাক্রমে খৃস্টান ও মুসলমানদের যদিও ছাত্রদের মধ্যে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ট।

স্কুল দুটি’র জাতীয় পর্যায়ে রয়েছে অনেক সুনাম।

হাসনাবাদ ও বান্দুরা’কে কেন্দ্র করে প্রচুর সংখ্যক খৃষ্টানদের বাস। খৃষ্টানদের মধ্যে তেমন কোন গরীব নেই বলতে গেলে, এরা সকলেই পয়সাওয়ালা।

তাদের প্রায় সব বাড়ীর পুরুষরাই জীবনের সবচে মূল্যবান সময়টা মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরী করে কাটিয়ে দেয় স্ত্রী-সন্তান-পরিবারকে একটু ভাল রাখবে বলে, হয়তো রাখেও তাই। তারা তাদের সন্তানদের জন্য বিদেশ থেকে সুন্দর সুন্দর গিফট নিয়ে আসে; সন্তানরা আবার সেই সব আকষণীয় গিফটগুলি ক্লাসে নিয়ে আসে বন্ধুদের দেখাতে যার মধ্যে থাকে চকলেট, কলম, পেনসিল, রাবার ইত্যাদি।

একদিন ছুটির পর আমরা স্কুল থেকে বের হয়েছি বাড়ী ফিরবো।
স্কুলের মাঠে হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম কি যেন একটা চকচক করছে।

কৌতুহল হল। হাত দিয়ে তুললাম। একটি অত্যন্ত সুন্দর কালারফুল কলম পড়ে রয়েছে। কলমটা তুলে নিলাম। সবাইকে দেখালাম, সবাই উৎসাহ দিল- দারুন জিনিস পেয়েছিস তো। নিয়ে বাড়ী গেলাম।
সবাইকে দেখালাম বাড়ীতে।

আমার আব্বা তখন ঢাকার দিলকুশায় সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা।

রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি।
আব্বা বাড়ী ফিরেন শনিবার সন্ধ্যায়, সোমবার ভোড়ে ঢাকা চলে যান অফিস করতে।

ওদিন ছিল সেই শনিবার।
সন্ধ্যার পর পর আব্বা ঢাকা থেকে ফিরলেন।

রাতে আমি খুব খুশী খুশী মন নিয়ে কলমটি বের করে আব্বাকে দেখালাম এবং ঘটনাটি খুলে বললাম কিভাবে পেয়েছি।

আমার শিশু মনের ধারণা ছিল আমার মত আব্বাও খুব খুশী হবেন।

আমার আব্বা এমনিতেই অত্যন্ত রাগী মানুষ।
তিনি প্রচন্ড রেগে গেলেন- ‘কেন আমি রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কলমটি স্কুলে জমা না দিয়ে বাসা পর্যন্ত নিয়ে এসেছি!’ কেন অন্যের জিনিসে লোভ করেছি? রাতে আমার খাবার বন্ধ।

আমার শিশুমন রীতিমত হকচকিয়ে গেল।
আমি শুধু এতটুকু বুঝতে পারলাম আমি অনেক বড় একটা অন্যায় করেছি। অন্যের জিনিসে লোভ করা যাবে না। খুব কষ্ট হচ্ছিল।

সোমবার সকালে আমাদের স্কুলের হেডমাষ্টার খিরোদ স্যারের কাছে কলমটি ফেরত দিয়ে আসলাম; স্যার আমার আব্বাকে চেনেন।
তিনি ‘আমার আচরণে’ অত্যন্ত খুশী হলেন।

ঘটনাটা এখানে শেষ হল না। পরের সপ্তাহে শনিবার রাতে আব্বা বাড়ীতে ফিরলেন। খাওয়া দাওয়া শেষে আমাকে নিজের কাছে ডাকলেন। আমি ভয়ে ভরে তাঁর কাছে গেলাম। ওনি তার ব্যাগ থেকে একটা খুব সুন্দর কালো কলম আমাকে বের করে দিলেন। কলমটিতে দেখলাম খোদাই করে বাংলায় ‘খন্দকার তৌফিকুল ইসলাম’ লিখা রয়েছে।

সেই ১৯৮০-৮১ সালে বিষয়টা মোটেও সহজ ছিল না। ওটা ছিল আমার জীবনে পাওয়া সবচে সুন্দর, সবচে পবিত্র গিফট। আমার আব্বা শুধু আমার জন্যই নয়, আমার বাকী ৪ ভাই-বোনদের নামেও আরও ৪টি কলম নিয়ে এসেছিলেন এবং সবাই দিলেন।

(সেই থেকে কলমের প্রতি আমার প্রচন্ড লোভ। আমার এক ষ্টুডেন্ট আমাকে একবার ৫ হাজার কলম গিফট করেছিল- সে ঘটনা আরেকদিনের জন্য তোলা রইলো।)

আমার আব্বা ছিলেন সততার এক জলন্ত উজ্জ্বল উদাহরণ।
এমনিতে আমরা ভয়ে ওনার আছে পাশে থাকতে চাইতাম না।

যতদিন গ্রামের বাড়ীতে থেকেছি- মাগরিবের আজান হবার পর শুধু মাগরিবের নামাজ শেষ করে সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবার আগেই বাড়ীতে ফেরাটা ছিল আমাদের জন্য ‘সান্ধ আইন’ তুল্য।

মনে আছে, তখনও সম্ভবত ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি।
আমাদের গ্রামের একটা ছেলে আমাকে কটু কথা বললে আমিও ওর সাথে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে যাই এবং এক পর্যায়ে কিছুটা হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে- ওটাই আমার জীবনের একমাত্র মারামারির ঘটনা। ওই ছেলেটা যে ভাল না, এটা গ্রামের সবাই জানে।

রাতে বাড়ী ফেরা মাত্র- আমার উপর শুরু হল উত্তম মাধ্যম।

আমাকে আমার আব্বা আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগই দিলেন না।

ওনার একটাই প্রশ্ন, ‘ওই ছেলেটা কেন সুযোগ পেল তোমাকে কটু কথা বলার, নিশ্চয়ই তুমি তাকে সুযোগ দিয়েছো। কেন তাকে সুযোগ দিলে?’।

বুঝলাম, আমার আব্বার রাজত্বে বসবাস করতে হলে কারো সাথে কোন ঝগড়া দুরে থাক তর্কেও জড়ানো যাবে না।

এভাবেই বড় হয়েছি আমরা।

আমার ফ্যামেলীতে কেউ দেশের বাইরে থাকে না; চাচাদের কথা ভিন্ন।

আমি তখন সবে ব্যবসায় শুরু করেছি।
১৯৯৬ সালে জীবনে প্রথমবার ইন্ডিয়া যাব। প্রস্ততি সম্পন্ন।

সকালে আব্বা অফিসে যাবেন, আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কত ডলার সাথে নিচ্ছি? বললাম। সাহায্য করার কেউ রয়েছে কিনা ইন্ডিয়াতে, বললাম না নেই।

আব্বা আমার মা’র গলার একটি স্বর্ণের চেইন আমাকে দিয়ে বললেন এটা গলায় দিয়ে যাবার জন্য। ছেলেরা গলায় চেইন দেবে এটা আমি আমার আব্বার কাছ থেকে কোনদিন শিখিনি।

বিষয়টা ওনার শিক্ষার বিপরীত হয়ে গেল। আমি নিব না।

উনি আমাকে বললেন, ওখানে বিপদে পরলে কেউ তোমাকে হেল্প করবে না। টাকা হারিয়ে গেলে- কোথায় দেশে ফেরার টাকা পাবে, কেউ দেবে না। তখন চেনটা বিক্রি করে দেশে ফিরবে। সব যুক্তি মানলেও আমি সেদিন চেনটি নেয়নি এবং আমার দীর্ঘ বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাসে বিদেশে আমার কোনদিন কোন বিপদ হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ।

দেশের ব্যবসায়ের অবস্থা ভাল না, বিশেষ করে ঢাকা শহরে থেকে সৎভাবে ব্যবসায় করে জীবনযাপন করা যে কতটা কষ্টকার সেটা ওনি বেশ ভালই জানতেন।

উনি সম্ভবত সন্তানদের পড়তেও পারতেন।
২০১৪ সালের আগষ্ট মানে আব্বা একদিন আমাকে বললেন, দেশের অবস্থা তো ভাল না। তোমার ব্যবসায়ও যে খুব ভাল যাচ্ছে- তাও বুঝতে পারছি না। তোমার যেহেতু আমেরিকার ভিসা রয়েছে; আমেরিকায় তো কেউ খারাপ নেই। তুমি চেষ্টা করলে সেখানেও অনেক ভাল করতে পারবে। আমার মনে হয় তোমার আমেরিকা-ই চলে যাওয়া উচিত।

হঠাৎই মনে হলো, আমার আব্বার কথাটা আমার সোনা উচিৎ।
সত্যি বলতে দেশ ছাড়ার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না।
কিন্তু কেন জানি মনে হলো, আব্বার কথাটা শুনি।

২০১৬’র জানুয়ারী, আমার আব্বা খুব অসুস্থ।
মিডফোর্ড, সালাউদ্দিন হসপিটাল ঘুরে সম্ভবত ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হবেন।

অনেক দুর থেকে আমি শুধু আব্বার জন্য দোয়া-ই করতে পেরেছিলাম।
সরাসরি তাঁর জন্য কিছু করতে পারছি না, খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। ঢাকা থাকার সুবাদে আমার আব্বা-মা’র অসুস্থতার চিকিৎসা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতাম, তাদের জন্য কিছু করতে পারলে খুব শান্তি পেতাম।

২০১৩ সালেও আমি আব্বার চোখের অপারেশন করিয়ে দিলাম।
তখনও আব্বা অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ডায়াবেটিসও অনেক হাই।

আব্বার লিউকেমিয়া ধরা পরেছে। বয়স আশিরও উপরে। অত্যন্ত দূর্বল শরীর। আমার দু বোন ঢাকা থাকে, ওনারা দেখছেন; আমার ছোট ভাই তৌহিদ বগুড়া থাকতো তখন, ও ঢাকা এসে দৌড়াদৌড়ী করছে।

ঢাকার ডাক্তাররা কেমোথেরাফীর কথা বলছে- কিন্তু আমি রাজী নই। আমি জানি তার শরীর কেমোথেরাফী নেবার মতো অবস্থায় নেই। শুধু শুধু পোষ্ট-কেমোথেরাফী’র কষ্ট দেবার কোন মানেই হয় না।

লক্ষ্নৌতে আমার বন্ধু ভারতবর্ষের বিখ্যাত রেডিওথেরাপিষ্ট বিখ্যাত কিং জর্জ মেডিকল (formerly Chhatrapati Shahuji Maharaj Medical University) এর বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর ক্যাপ্টেন ডা. এমএলবি ভাটের সংগে কয়েক দফা কথা বললাম, তিনি ইমেইলে পাঠানো রিপোর্ট দেখে সম্ভব হলে তার কাছে নিয়ে যেতে বললেন এবং মহান আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য বেশী বেশী দোয়া করতে বললেন।

আমি ডা. ভাটকে চিনি।
তিনি আমাকে কৌশলে ‘শক্ত হবার’ পরামর্শ দিচ্ছেন- সেটাও বুঝি।

কিন্তু আমি তো কিছু করতে পারছি না!
নিজেকে এই পৃথিবীর সবচে অক্ষম মানুষ মনে হচ্ছে- যে, নিজের পিতার জন্য কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না এই ১০ হাজার মাইল দূরে থেকে!

এই লেখাটা লিখেছিলাম ২০১৬র জানুয়ারীর ১৬ তারিখে।
আমার আব্বা মারা যান ২৩শে জানুয়ারী, সপ্তাহ খানেক পর; বাংলাদেশের সেদিন ২৪শে জানুয়ারী সকাল। নিউ ইয়র্কে সেদিন ব্লেজার্ড হচ্ছিল। সেই ভয়াবহ তুষার ঝড়ের মধ্যেই আমার ছোট ভাইয়ের ‘সেই’ ফোন কল পেলাম!

বাবারা সন্তানকে ভালবাসেন সারাজীবনই- কিন্তু একজন সন্তান সত্যি বলতে- বাবার প্রতি ভালবাসা টের পায় তাঁর মৃত্যুর পর। এই বছরগুলিতে এমন একটা মুহূর্তও যায়নি- যখন বাবার কথা মনে পরেনি। আর যখনই মনে কোন আনন্দ অনুভব করি তখনই আব্বার কথা খুব বেশী করে মনে চলে আসে।

কতবার যে চোখের জল পরেছে- নিজের অজ্ঞাতে শুধু ‘এই মানুষ’টার জন্য তার কোন হিসাবে নেই।

অনেক ভালবাসি আমার আব্বা কে।
যা কোনদিনও তাঁকে বলা হয়নি।
আর কোনদিন বলার সুযোগও নেই।
বাবা’রা হয়তো এটাও জানেন।
তারা তো সন্তানকে পড়তে পারেন, তারও তো বাবা ছিলেন।

একটু যদি সুযোগ পেতাম আব্বাকে একটিবার মাত্র জড়িয়ে ধরে বলতাম, আব্বা আপনাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু সেই সুযোগটি কোনদিনই আসবে না।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *