আইফোনের সেই গল্পটা


আমি সবসময় যে-কাজটা করি তা হলো কেএলআইএ (কুয়ালা লামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) থেকে পুডু-রাইয়া যাবার সময় পাবলিক বাসে (মাত্র ১০ রিংগিট ভাড়া) করে চলে যাই- লাগেজ তেমন একটা থাকে না; তাছাড়া পুডু-রাইয়া বাস ষ্টেপজে নেমে মিনিট দুয়েক হেটেই চায়না টাউনের ‘এলেক্সসেস হোটেল’;- ওখানেই আমি সাধারণতঃ থাকি।
 
আর দেশে ফেরার সময় পুডু-রাইয়া চায়না টাউন থেকে একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে (কমবেশী ৮০ রিংগিট ভাড়া) কেএলআইএ চলে আসি- ঝামেলা মুক্ত ৪০ মিনিটের নির্ঝাঞ্জাট জার্নি।
 
২৪শে জুন ২০১৪।
লেট-নাইট চারটা কুড়ি মিনিটের বিমানের ফ্লাইটে কুয়ালা লামপুর থেকে ঢাকা ফিরবো। চায়না টাউনের জালান সুলতান দিয়ে হাঁটছি- ঝকঝকে নতুন একটা ট্যাক্সি ক্যাব দাড়িয়ে রয়েছে। ট্যাডিশনাল সাদা সার্ট পরা ৫০/৬০ বছরের চাইনিজ ট্যাক্সি ড্রাইভার, দেখতে ভীষন স্মার্ট, দাড়িয়ে রয়েছেন। গাড়ী এবং ড্রাইভার দুজনকেই পছন্দ হওয়াতে জিজ্ঞেস করলাম রাত ঠিক সারে বারটায় আমাকে আমার হোটেলের নিচ থেকে পিক করে এয়ারপোর্ট পৌছে দিতে পারবে কিনা? ড্রাইভার ৮০ রিংগিট ভাড়া চাইলো। আমি বার্গেনিং করলাম না; তার মোবাইলে একটি মিসড কল দিয়ে মোবাইল নাম্বার বিনিময় করলাম।
 
ঠিক সাড়ে বারটায় আমি হোটেল থেকে নিচে নেমে দেখি ড্রাইভার দাড়িয়ে।
গাড়ী স্টার্ট দিয়ে সে জানালে যে, সে তার এই গাড়ীটা মাত্র ২৬ দিন আগে কিনছে; আনকোড়া নতুন। সে শুধু রাতেই ড্রাইভিং করে। দিনে ঘুমায়। বউ চাইনিজ এবং সম্পূর্ণ হাউজ ওয়াইফ। তিনটি ছেলেমেয়ের সকলেই গ্রাজুয়েট। বড় ছেলেটা বিয়ে করেছে। মেঝটা জার্মানীতে ইনজিনিয়ারিং পড়ছে আর একমাত্র মেয়েটি অবিবাহিতা, ও জব করছে। খুবই সুখী পরিবার। তার ঠাকুরদা বেইজিং থেকে ১৯৪২ সালের দিকে মালয়েশিয়াতে দেশান্তরী হয়েছে। তার জন্ম মালয়েশিয়াতেই; তখন মালয়েশিয়া ছিল বাঘের রাজ্য। দেশের অবিশ্বাশ্য উন্নতিতে তারা খুবই আনন্দিত এবং তারা সকলেই মাহথির মুহাম্মদ এর প্রতি ভীষন কৃতজ্ঞ।
 
কথা বলতে বলতে সে আমাকে রাতের কুয়ালা লামপুরের রাস্তার দুপাশের স্থাপনাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুল করছিল না।
 
পুত্রজায়া, সাইবার জায়া সবই সে আমাকে চিনিয়ে দিচ্ছিল। খুবই প্রাণখোলা চাইনিজ ভদ্রলোকের নামের প্রথম এবং শেষ নামটি আমি মনে রাখলাম। মি. ওই বান।
 
এবার মূল প্রসংগে ফিরি।
 
আমি ঢাকাতে আমার গাড়ীতে ম্যাক্সিমাম টাইমেই আমার ড্রাইভারের পাশে অর্থাৎ সামনের আসনেই বসি। আমার আইফোনটি রাখি আমার দু’পায়ের মাঝে- বসার সীটের উপর। মানুষ অভ্যাসের দাস। ট্যাক্সি ক্যাবটির মালিক যে আমি নই- সেটাতো কেউ আমাকে মনে করিয়ে দেয়নি। কাজেই ওখানেও আইফোনটি রেখে কথা বলতে বলতে হালকা ঘুমিয়ে পরেছি।
 
হঠাৎ গাড়ীটি থেমে যাওয়ার চোখ মেলে দেখলাম- ৩নং গেটে ইন্টারন্যাশনাল ডিপার্চার-এ চলে এসেছি। তখন রাত ১.১০মিনিট। গাড়ী থেকে নামলাম, ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আমার মালপত্র তারাতারি একটি ট্রলিতে তুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। বিমানের বোর্ডিং রো খঁজতে যাবার পূর্বে পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম- আইফোনটি গাড়ীতে রেখে নেমে গিয়েছি।
 
অর্থাৎ- আমার আইফোন মিসিং।
 
স্টুপিড আমি, সবসময় ট্যাক্সি ক্যাবের নাম্বারটি মুখুস্থ রাখলেও ড্রাইভার ভদ্রলোককে পছন্দ হওয়ায় গাড়ী নাম্বারটি মনে রাখার চিন্তা করিনি।
দৌড়ে বের হয়ে রাস্তায় এসে গাড়ীটি খুঁজলাম; পেলাম না। চলে গেছে। আমার আইফোনটিও গেছে- মানে আমার সবই গেছে। ৫ হাজারের বেশী বিজনেস কন্ট্রাকস্ নাম্বারসহ হাজারো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন আমার হারিয়ে গেছে। একজন ব্যবসায়ীর নিকট এটা যে কত বড় ক্ষতি- সেটা ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ উপলক্ধী করতে পারবে না।
 
অতি প্রিয়জন হারিয়ে যাবার মতোই কষ্ট পাচ্ছিলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শব্দটা বোধহয় এরকম সমস্যা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল।
 
আমি কোন বিপদে পড়লে চোখ বন্ধ করে নু্ন্যতম ৫ মিনিট বসে থেকে নিজেকে আগে নিয়ন্ত্রণ করি এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অটো-সাজেশন নিই। তাই করলাম। প্রথম সিদ্ধান্ত নিলাম- আমার হারিয়ে যাওয়া আইফোন যে-কোন মূল্যে উদ্ধার করতেই হবে।
এয়ারপোর্ট ইনফরমেশন ডেক্স খুঁজে বের করলাম। পিচ্চি একটা মেয়ে বসা। ইংরেজী ভাল জানে না। মালয় মেয়েটি আমার মোবাইল নাম্বারটি চাইলো;
নতুন নাম্বারটি আজই কেনা। মুখস্ত করা হয়নি। পরিস্কার মনে আছে আমার নতুন এই নাম্বার থেকে করা দ্বিতীয় কলটি ছিল ড্রাইভারের নাম্বার। পকেট হাতরে নাম্বারটি বের করলাম, ওকে দিলাম; সে কল দিলো। বলল- ‘মোবাইল অফ; ড্রাইভার চুরি করে পালিয়েছে।’
 
আমি বললাম, এটা অসম্ভব। সে চোর হতে পারে না। আমি তার সাথে প্রায় ২৫/৩০ মিনিট কথা বলেছি। সে খুবই ভাল মানুষ- আমি মানুষ চিনতে ভূল করি না।
 
মেয়েটি বলল, সরি। সে যদি ভাল মানুষই হয় তবে- মোবাইল সুইচ অফ করলো কেন?। গুরুতর কোশ্চেন!
 
আমি তাকে বললাম, আমি পুলিশ রিপোর্ট করবো। সে বলল, পুলিশ কোন হেল্প করবে বলে মনে হয় না। তবে তুমি রিপোর্ট করতে পারো।
 
মেয়েটি আমাকে এয়ারপোর্ট পুলিশ হেল্প ডেক্স দেখিয়ে দিল। আমি ট্রলিটি নিয়েই মালয়েশিয়ান পুলিশ ডেক্সটি খুঁজে বের করলাম।
 
৩জন এএসআই পদ মর্যাদার পুলিশ বসা। আমি ভেতরে ঢুকে বসলাম। নিজেকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে সম্পূর্ণ ঘটনা-টা তাদের বললাম এবং মোবাইল উদ্ধার করা যে বর্তমান এই প্রযুক্তির যুগে খুবই সহজ একটি বিষয় সেটাও সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা তাদের দিলাম। তাদের ইন্টিলিজেন্ট তথা আইটি ডিপার্টমেন্টকে আমার কমপ্লেইনটি ফরওয়ার্ড করতে অনুরোধ করলাম।
কিন্তু তাদের মধ্যে আমাকে সহযোগীতা করার কোন উৎসাহ দেখলাম না। তারা ব্যস্ত হলো আমার কেনা টেলিভিশনটির দাম কত? বাংলাদেশে টেলিভিষন এর মূল্য অনেক বেশী কিনা; ইত্যাদ্যি।
 
আমি বিরক্ত হলাম; কিন্তু নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করলাম। ওদের সহযোগীতা না পাই- পুলিশ কমপ্লেইন আমাকে করতেই হবে।
 
ওরা কমপ্লেইন না নেবার জন্য পর্যাপ্ত চেস্টা চালালো। তারা সিসিটিভি ক্যামেরা চালিয়ে ড্রাইভারের চেহারা বের করার বিষয়ে খুব উৎসাহ দেখালো।
আমি পুলিশকে বুঝালাম- আমার নতুন কেনা মোবাইল নাম্বার থেকে ২য় কলটির নাম্বার যদি অপারেটার থেকে (কল ডিটেইলস) বের করা যায় তবে সহজেই ড্রাইভার কে ধরা সম্ভব। আর তাছাড়া আমার আইফোনের আইএমইআই নাম্বারটিও আমার কাছে রয়েছে- যেটা থেকে খুব সহজেই আমার মোবাইলটি কোথায় আছে বের করা সম্ভব।
 
পুলিশ আমাকে কোন পাত্তাই দিচ্ছে না।
 
আমিও নাছোরবান্দা। শক্ত হয়ে জেকে বসলাম। কমপ্লেইন না করিয়ে যাব না। এদেকে ফ্লাইট এর সময়ও দ্রুত ঘনিয়ে এসেছে- বোর্ডিং কার্ড নেয়া হয়নি। এবার আমি আস্তে আস্তে গরম হচ্ছি। পুলিশের সাথে কড়া ভাষায় চলে যাচ্ছি। বাংলাদেশ হলে রাব দিয়ে এতোক্ষণে মোবাইল টি উদ্ধার করিয়ে ফেলতাম ইত্যাদ্যি চাপা মারাও শুরু করে দিলাম।
 
অবশেষে ওরা বাধ্য হলো আমাকে সহযোগীতা করতে। ঘন্টাখানেক সময় নষ্ট করে আরেকজন অফিসারকে তারা ডেকে নিয়ে আসলো।
 
সে আবার প্রথম থেকে আমার বক্তব্য শুনে কমপ্লেইন নিতে রাজি হলো। নিজেই কমপিউটারে বসে আমার বক্তব্য অনুযায়ী কমপ্লেইনটি ড্রাফট করে আমাকে দেখালো। তারপর প্লিন্ট করে আমার স্বাক্ষর নিয়ে, অফিসার তার স্বাক্ষর, সীল দিলে। একটি কপি আমাকে দিল। অনলাইন নাম্বারটিও দিল। আমার প্রেশারে তার হেড-কোয়াটারের কন্ট্রাক্ট নাম্বার, ইমেইলও দিল।
 
ওদের ব্যবহার আমাকে জানিয়ে দিল, ‘আইফোনের আশা তুমি ছেড়ে দাও!’
অপরদিকে আমিও নাছোরবান্দা। সিদ্ধান্ত একবার যেটা নিয়ে ফেলেছি- সেটা করবই; আমার আইফোন আমি উদ্ধার করবোই; সেটা যে-কোন মূল্যে।
কিন্তু সত্যি বলতে কি আমার মাথা কাজ করছিল না।
 
চুড়ান্ত বোর্ডিং ব্রীজে যাবার আগে টয়লেটে যেয়ে একটু ফ্রেস হয়ে বোর্ডিং ব্রীজের সামনে এসে বসে আছি; মাথা থেকে আইফোন হারানোর দুঃখ দূর করতে পারছি না। সত্যিই নিজেকে আইফোন ছাড়া খুবই অসহায় লাগছিল।
 
লম্বা কিউ-ই তে আমি কখনও দাড়াই না। সকলে যাবার পর আমি বোডিং ব্রীজে যাব; বসে আসি। কিউ-ইতে লোকের সংখ্যা কমছে। হঠাৎ সম্পূর্ণ অপরিচিত, অচেনা একটি ছেলে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল- আপনি-ই কি তৌফিকুল ইসলাম পিয়াস?
 
আমি অবাক হলাম? এখানে তো আমাকে আমার নাম ধরে চেনার মতো কেউ নেই? তাহলে প্রবলেন্মটা কোথায়?
 
আমি মাথা নাড়াতেই সে বলল আপনার পাসপোর্ট কোথায়?
বুঝে ফেললাম, আমার অবস্থা এতটাই খারাপ যে- আইফোনের দুঃক্ষে নিজের পাসপোর্ট, বোডিং কাডও হারিয়ে ফেলেছি!
 
আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম- ওটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে?
ছেলেটি হাসিটার কোন উত্তর না দিয়ে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আপনার মতো প্রফাইলের একজন মানুষ তার পাসপোর্ট-বোডিং কার্ডসহ টয়লেটে ফেলে এসে এখানে নিশ্চিন্তে বসে আছেন এটা মানাচ্ছে না। আপনার পাসপোর্টে আমেরিকার ভিসা রয়েছে। আপনি শতশতবার বিদেশ ভ্রমণ করছেন- আমরা সত্যিই খুব অবাক হয়েছি।
 
আমি ধন্যবাদ দিলাম, কৃতজ্ঞতা জানালাম। সেই সাথে আমার আইফোন হারানোর কথাও বললাম। কিন্তু তার বিরক্তি কমলো না।
 
ঢাকা ফিরলাম। ঠিকমত কাজে মন বসাতে পারছি না। আর কি কি করা যায় ভাবছি। মালয়েশিয়ার পুলিশ থেকে হেল্প পাবার সম্ভাবনা কম। পাবলিকের সাথে আলাপ হলে সবাই বলে ওটা আর পাওয়া যাবে না। মালয় ড্রাইভার তো? ও পাবেন না! যখন বলি- না চাইনিজ ড্রাইভার। উত্তর পাই- ওরা আরও খারাপ। বাংলাদেশের মানুষ ঢালাও এবং নেগেটিভ মন্তব্য করে খুব মজা পায়।
 
কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা!
সম্ভাব্য সবগুলো উপায় চিন্তা করছি।
 
অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম- খুব সুন্দর করে গুছিয়ে মালয়েশিয়ান পুলিশতথা অন্যান্য ইন্টিলিজেন্ট সার্ভিসকে একটিা ই-মেইল করবো। যুক্তি, ইমোশন, ব্যাখ্যা- তিনটি অস্ত্র প্রয়োগ করে একটি ইমেইলও লিখে ফেললাম। সেন্ড করে দিলাম- সবগুলো ইমেইল এ সিসিসহকারে। মালয়েশিয়ার চুরি, উদ্ধার, ক্রাইম কোন ডিপার্টমেন্টকেই বাদ দিলাম না।
 
তিন দিন পর হঠাৎ আমার আইডি থেকে আমার ফেসবুক এ একটা ম্যাসেজ পেলাম:
Hii..u phone is on my hand now…..pls contact me to take back you phone
 
তারপর আর কোন সাড়া নেই।
 
আমি আশ্চর্য্য হলাম।
তারপর সপ্তাহ খানেক কেটে গেল।
 
আমি আবার উড়াল দিলাম কুয়ালা লামপুর। সকালে পৌছলাম। আরও একটা সীমকার্ড কিনলাম। তখনও আমার মন ভাল হয়নি। কখন রাত হবে, আমি যেখান থেকে ড্রাইভারকে হায়ার করেছিলাম সেখানে ড্রাইভারকে খুঁজবো। ড্রাইভারকে খুঁজে বের করতেই হবে। আমি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। হারিয়ে যাবার তিন বছর পর আমার একটি গাড়ী আমি খুঁজে বের করেছি; উদ্ধার করেছি। সেটা ঢাকা শহরেই।
 
যাই হোক। স্থানীয় পুলিশ বক্সএ যেয়ে কমপ্লেইনটি দেখিয়ে চেষ্টা করলাম কোন তথ্য বা অগ্রগতি পাওয়া যায় কিনা? কোন লাভ হল না। অধিকাংশ লোকেরই বক্তব্য- আমার কমপ্লেইনটি কোন এক অফিসারের ড্রায়ারের তলানীতে চাপা পরে রয়েছে!
 
আমি কখনওই হতাশ হই না। এতেও হচ্ছি না।
 
রাত ঠিক সাড়ে নয়টা। আমি পুডু-রাইয়া চায়না টাউনের জালান সুলতান-এ দাঁড়িয়ে রয়েছি। প্রত্যেকটা গাড়ী খুঁজছি- চাইনিজ ড্রাইভার কেও খুঁজছি। আমার বিশ্বাস আমি ড্রাইভারকে খুঁজে পাবোই।
 
সাড়ে দশটা। সারে এগারোটা।
 
পা ব্যাথা হয়ে গেছে। দীর্ঘখন একই স্থানে দাড়িয়ে রয়েছি। অনেকেই আড়চোখে আমাকে দেখছে।
 
এবং হঠাৎ! হঠাৎ আমার চোখ থেমে গেল একজন বয়স্ক সাদা সার্ট পড়া চাইজিন ড্রাইভারের মুখে। ঐ তো ড্রাইভার ওই বান। দৌড়ে গেলাম তার সামনে। সে দাড়িয়ে রয়েছে। আমাকে দেখলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম- আমাকে চিনতে পারছো?
 
সে বলল, না। আমি ততক্ষণে তার গাড়ীর নাম্বার টি (৩৭৭১) মুখস্থ করে ফেলেছি।
 
তখন তাকে আমি বললাম, গত সপ্তাহে আমি তোমার গাড়ীতে করে এখান থেকে এয়াপোর্ট গিয়েছি। তোমার গাড়ীতে আমি আমার আইফোনটি হারিয়েছি। তুমি আমাকে চিনতে পারছো না?
সে বলল- না। তোমার নাম কি?
আমি আমার নাম বললাম।
 
সে প্রশ্ন করল, তুমি কোন হোটেলে থাকতে।
আমি উত্তর করলাম।
 
এবার সে আমাকে চিনল। বলল, তোমার মোবাইলে তো চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি চার্জার পাবো কোথায়? তাই তোমার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আমার মেয়ে তোমাকে একটি মেসেজে ফেসবুকে দিয়েছিল। কিন্তু আর মোবাইলটি অন করা সম্ভব হয়নি। তুমি তোমার হোটেলে থাক- আমি ১ ঘন্টার মধ্যে আমার বাসা থেকে তোমার আইফোনটি নিয়ে আসছি। চিন্তা করো না। আমি এই এলাকায় গত ২৭ বছর ট্যাক্সি ক্যাব চালাই। তোমার আইফোন তুমি পাবে।
 
আমি আইফোন পাবোই। কারণ সে স্বাীকার করেছে এবং আমি এখন তার গাড়ীর নাম্বার জানি।
 
আমার সময় আর কাটছে না।
 
রাত দুটো অবধি ড্রাইভার এর জন্য দাড়িয়ে রইলাম জালাল সুলতান-এ। নেই, নেই, কোন খবর নেই। তার মোবাইল নাম্বারটি কেন নিলাম না?
 
কিন্তু আমার মন বলছে সে ফিরবে।
 
আড়াইটার দিকে হোটেলে ফিরলাম। হোটেল রিসিপশনের সকলেই আমার সাথে খুব ফ্রি। সকলেই আমাকে চেনে। আমি তাদেরকে পুরো ঘটনাটা বললাম। তারাও অবাক হল। আমি বললাম- আমার বিশ্বাস ড্রাইভার মোবাইল দিয়ে যাবে। সে আসলে যেন- আমাকে ডেকে দেয়।
 
আমি রুমে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
 
রাত সাড়ে তিনটার দিকে রুমে ঠক ঠক শব্দে আমার ঘুম ভেংগে গেল। আমি শিউর ড্রাইভার।
 
গেইট খুলতেই দেখি রিসিপশনের মেয়েটি। বলল- চাইনিজ ড্রাইভার তোমাকে খুঁজছে।
 
আমি নীচে নামলাম। মি. ওই বান দাঁড়িয়ে, হাতে আমার আইফোন। অনেক বেশী রাত হওয়াতে সে দুঃখ প্রকাশ করল। আমি তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম। পরদিন কথা হবে বলে সে চলে গেল।
 
ঘটনাটা সেখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হল না।
 
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম ১০টা দিকে। ফ্রেস হলাম। কমপ্লিমেন্টারী ব্রেকফাস্ট আওয়ার শেষ। আমি নিচে গিয়ে চায়না টাউনের চাইনিজ ব্রেকফাস্ট কিনে খাচ্ছি। ঠিক পোনে এগারটায় আমার এই মোবাইলে একটা ফোন এল। আমি অবাক হলাম- এই নাম্বারতো কেউ জানে না! কি ব্যাপার? কে হতে পারে?
 
ফোন রিসিভ করলাম।
 
ওপাশ থেকে কন্ঠস্বর ভেসে এলো- আমি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট Kandasan, তুমি কোথায়?
 
আমি বললাম, আমি চায়না টাউনে। সে বলল- আমি তোমার হোটেলে, তুমি একটু আসবে? আমি বললাম, ওকে ওয়েট প্লিজ।
 
ভীষন অবাক হলাম আমি। ডিটেকটিভ সার্জেন্ট আমার হোটেলে কেন?
 
হোটেলে ব্যাক করলাম। সিভিল ড্রেসে কালো তামিল পুলিশ অফিসার হাসি হাসি মুখে বসা। আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে ওর আইডি কার্ডটি দেখালো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার, আপনি আমাকে খোঁজ করছেন কেন?
ভদ্রলোক সুন্দর করে হাসি দিয়ে বলল- আপনি যদি ভোর রাতে আপনার ফোনটি না-ও পেতেন; তাহলে আজ বিকেল ৪টার মধ্যৌ আমি আপনাকে এটা পৌছে দিয়ে যেতাম।
 
আমি হেসে বললাম, ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল’।
 
অফিসারও হাসলো।
আমাকে বলল, আমি জানতাম আপনি এটাই বলবেন। চলুন আমরা কোন রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বসি।
 
আমি বললাম চলুন। পাশের কেএফসিতে গিয়ে বসলাম।
আমি সাধারণতঃ দুপুরে কিছু খাই না। তাকে সেটা জানিয়ে তার জন্য লান্স অফর করলাম। কিন্তু সে বলল না, সে- আমাকে খাওয়াবে। আমি তার দেশের গেষ্ট।
 
আমি রাজি হলাম না।
অবশেষে সে আমার অফার গ্রহন করল। হালকা কিছু খাবার নিল। আমি স্রেফ পেপসী।
 
সে তার সকল কাগজ-পত্র ব্যাগ থেকে বের করল। প্রথমে দেখালো আমার লেখা ই-মেইলটি যেটা আমি পুলিশ হেড-কোয়ার্টারকে দিয়েছিলাম ২৮ তারিখে এবং তার কাছে ফরোয়ার্ড করা হয়েছে ২ তারিখে। আর আজ ৫ তারিখ। এই সময়ের মধ্যে সে আমার এডভাইস মতো মোবাইল অপারেটর থেকে কল ডিটেলস বের করেছে। গতকাল ড্রাইভারের মোবাইল নাম্বারটি কনফার্ম করেছে এবং আমার এডভাইসের বাইরেও সে তার নিজের ট্রেনিং অনুযায়ী সম্ভাব্য সবগুলো সাসপেক্টও আমাকে দেখালো। আজ ছিল তার ফাইনাল মিশন। আজকের মধ্যে সে ড্রাইভারকে এরেস্ট করে আমার আইফোনটি উদ্ধারের পরিকল্পাও সে আমাকে দেখালো। এমনকি সে আমার বাংলাদেশের মোবাইলএ ও আজ সকাল থেকে কয়েকবার কল করার চেস্টা করেছে- নাম্বার বন্ধ পেয়েছে। সকাল ৭টায় সে ড্রাইভারের সাথে কথা বলেছে। এবং তার অবস্থান নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু ড্রাইভারই তাকে জানিয়েছে যে- সে আজ ভোর রাতে আমাকে ফোনটি ফেরত দিয়েছে এবং অামি এখন কুয়ালা লামপুর-এ রয়েছি; হোটেলের এড্রেসও দিয়েছে।
 
তার প্রত্যেকটা কথা ও কাজের ডকুমেন্ট সে আমাকে দেখিয়ে বলল, “তুমি মালয়েশিয়ান পুলিশের কাজে সন্তুষ্ট কিনা?”
 
আমি বললাম আমি খুশি এবং তোমাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সে বলল, তুমি যে খুশি এবং আমাদের কে এই ধন্যবাদটা অনুগ্রহ করে একটু লিখিতভাবে দাও।
 
আমি আমার ভাষায় মালয়েশিয়ান পুলিশকে লিখিত ধন্যবাদ দিলাম।
 
সে আমাকে বলল, আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু। তুমি যতবার মালয়েশিয়া আসবে- আসা ও যাবার সময় আমাকে অবশ্যই এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করবো- আমি তোমার সাথে মিট করব।
 
আর মালয়েশিয়াতে যে-কোথাও তোমার কোন সমস্যা হলে তুমি সরাসরি আমাকে ফোন করবে। আমি তোমাকে সবোর্চ্চ ১০ মিনিটের মধ্যে আঈনী প্রটেকশন দিবো। মালয়েশিয়াতে তোমার মতো একজন ব্যবসায়ীর আমার মতো একজন বন্ধু থাকা খুবই দরকার।
 
সবশেষে সে আমাকে বলল, তুমি যদি পুলিশ হেড-কোয়াটারে মেইল টা না করতে তাহলে তোমর কমপ্লেইনটি ড্রয়ারের তলানীতেই পরে থাকতো। আর হেড-কোয়াটার আমাকে সাধারণত হারিয়ে যাওয়া বস্তুগুলোই উদ্ধারের দায়িত্ব দেয়। আমার দেখা তুমিই একমাত্র বিদেশী যে নিজের হারিয়ে যাওয়া জিনিসটি নিজেই উদ্ধার করেছে। তেমাকে ধন্যবাদ।
 
সে আমাকে ফেরার দিন এয়ারপোর্ট সিঅফ করল এবং আমাকে একটি গিফটও প্রদান করেছিল।
 
আমি পুলিশ অফিসারের নিকট ড্রাইভারের প্রসংশা করাতে সে আমাকে শুধু একটা প্রশ্ন করলো- ‘তুমি কি ড্রাইভারকে প্রশ্ন করেছিলে- সে আইফোনটি থানায় জমা না দিয়ে তার নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল কেন?’।
 
না। প্রশ্নটি করা হয়নি। আমি করিনি। কিন্তু ডিটেকটিভ পুলিশ অফিসারটি তাকে এটা নিয়ে প্রচন্ড জেরা করতে ছাড়েনি। এমনটি এরেস্টও করার হুমকি দিচ্ছিল। আমি পরে বিষয়টি রিকোয়েষ্ট করে সুরাহা করি।
 
ড্রাইভারকে বিদায়ের সময় টিপস দিই। ধন্যবাদ দিই। আর যেটা করি- প্রতিবারই পুডু-রাইয়া থেকে এয়ারপোর্ট যাবার পথে তাকে ফোন দিয়ে বলি, ‘ঠিক সাড়ে বারটায় হোটেল থেকে রওয়ানা হবো; এবং যদি কোন কিছু তোমার গাড়ীতে হারাই- এই হোটেলে আমার নাম লিখে জমা দিয়ে রাখবে’।
 
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *