দুবাই কথা


শ্রেফ মজা করেই দুবাইয়ে আমার কোম্পানীর অনুকুলে ১৯ টি ভিসা এলোকেট হবার কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি যে – এটিই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে আমার পাঠকের কাছে।

আমি লেখক মানুষ; সেই সংগে একজন ব্যবসায়ী যদিও আমেরিকার ইমিগ্রেশন নিয়েও কাজ করি। কিন্তু আদম ব্যবসা বা ভিসা-টিকেট নিয়ে আমার কোনই কারবার নেই; ততটা বুঝিও না এসব। এ বিষয়টি নিয়ে বোঝার আগ্রহও বরবরই কম।

কিন্তু গতরাতে পোস্টটি দেবার পর ইনবক্সে শ’খানেক অনুরোধ এসেছে ভিসার বিষয়ে জানতে এবং দুবাই যেতে সহযোগীতা করতে। সকলকে ইন্ডিভিজুয়ালী উত্তর দেয়া খুবই সময়সাপেক্ষ বিষয় এবং অতটা সময়ও আমি বের করতে পারবো না।

কাজেই, ভেবে দেখলাম পুরো বিষয়টি নিয়ে একটি আর্টিকেল লিখে ফেললে সকলেই তাদের উত্তরসমূহ পেয়ে যাবেন।

দুবাইয়ে আমি প্রায় ২ সপ্তাহ ছিলাম।

এর মধ্যে অনেকের সংগে কথা হয়েছে, দেখেছি, দুবাইকে বোঝার চেস্টা করেছি আমার মতো করে। সেই আলোকেই এই লেখাটি।

দুবাই ইউনাইটেড আরব আমিরাতের একটি স্টেট; এরকম আরও ৬টি স্টেটস নিয়ে আরব আমিরাত গঠিত। আমেরিকায় ‘ইমিগ্রেশন’ বিষয়টি ফেডারেল গভর্ণমেন্ট দেখ-ভাল করে; স্টেট গভর্ণমেন্ট এর কোন কর্তৃত্ব থাকে না। ক্যানাডায় ‘ইমিগ্রেশন’ বিষয়টি ফেডারেল গর্ভণমেন্ট এর পাশাপাশি স্টেটস (প্রভিনশিয়াল) গভর্ণমেন্টও স্বাধীনভাবে কর্তৃত্ব করে। আরব আমিরাতেও ক্যানাডার স্ট্যাইলে স্টেটসগুলো ‘ইমিগ্রেশন’ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; করেও।

দুবাই ইমিগ্রেশন ‘আমিরাত রেসিডেন্সী’কে তাদের ব্যবসার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তারা বলতে গেলে রীতিমত ‘রেসিডেন্সী’ বিক্রয় করে অর্থ উপার্যন করে থাকে। দুবাই বেশ এক্সপেনসিভ সিটি। এবং সরকারী সেবাগুলোর মুল্যও অনেক চড়া। দুবাই বলতে গেলে কাউকেই ’স্থায়ী রেসিডেন্সী’ দেয় না বা নাগরিকত্বও দেয় না। দুবাই ২ বা ৩ বছরের মেয়াদী অস্থায়ী ‘রেসিডেন্সী’ বিক্রি করে মাত্র। বিশ্বের যে-কোন দেশের যে-কোন নাগরিককেই তারা নগদ অর্থের বিনিময়ে অতি সহজে-বিনা-বাক্য-ব্যয়ে টুরিস্ট ভিসা; এবং ‘রেসিডেন্সী’ প্রদান করে থাকে।

যারা সরাসরি দুবাই গিয়ে ব্যবসা করতে চায় তাদের ’ইনভেষ্টর’ হিসাবে ৩ বছরের রেসিডেন্সী প্রদান করে। আর ইনভেষ্টর হিসাবে রেসিডেন্সী পেতে ওখানে একটি ব্যবসায়িক কোম্পানী করা বাধ্যতামূলক। এবং ঐ কোম্পানীকে প্রতি বছর রিনিও করাটাও বাধ্যতামূলক। এবং এসব প্রতিটি কাজেই মাত্রাতিরিক্ত গভর্ণমেন্ট ফি ও সার্ভিস ফি নিয়ে থাকে দুবাই সরকার। কোম্পানী ভিত্তিক রেসিডেন্সীর জন্য ১৫ হাজার দেরহাম থেকে ৫০ হাজার দেরহাম পর্যন্ত খরচ হতে পারে।

এরপর ঐ প্রতিটি কোম্পানীর অনুকুলে কিছু ‘কর্মী ভিসা’র জন্য ‘রেসিডেন্সী‘ প্রদান করা হয়। কোম্পানীর বিজনেস নেচার, সাইজ, ক্যাটাগরী ভেদে নির্ধারিত সংখ্যার রেসিডেন্সীর অনুমোদন দেয়া হয়। যেমন আমার কোম্পানীকে দেয়া হয়েছে ১৯ টি। এই ভিসাগুলো মেয়াদ ২ বছর করে এবং প্রতি ২ বছর পরপর এই রেসিডেন্সী রিনিও করতে হয়। এবং এসব কাজেই অনেক টাকা ফি নেয়া হয়।

মজার বিষয় হচ্ছে যে কোম্পানীর অনুকুলে ঐ সংখ্যার রেসিডেন্সী বা এমপ্লয়মেন্ট ভিসা দেয়া হচ্ছে – আগত কর্মচারীদের সেখানেই কাজ করা বাধ্যতামূলক নয়। অথবা আমার কোম্পানীর কোন লোকল এক্টিভিটিজ না থাকলেও আমি বাইরে থেকে কর্মী ভিসায় ২ বছরের রেসিডেন্সী দিয়ে লোক নিয়ে আসতে পারবো এবং তাদের স্বাধীন করে দিতে পারবো।

অর্থাৎ সোজা কথায়, এটা দুবাই সরকারের একটি ব্যবসা।

আগত কর্মচারীদের বিষয়ে কোম্পানী বা সরকারের কোনও দায়-দায়িত্ব নেই বললেই চলে। কর্মীরা চাইলে অতি সহজেই অন্য কোন কোম্পানীতেও ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারে। তারা চাইলে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারে, নিজের নামে কোম্পানী ওপেন করতে পারে; ভিসা নিজের কোম্পানীতে ট্রান্সফার করতে পারে; এমনকি নিজের কোম্পানীর অনুকুলে ভিসা নিয়ে সেই ভিসায় আবার নিজেই লোকবল নিয়ে আসতে পারে।

এর ফলে যেটা হয়েছে তা হলো – দুবাই এ সারা পৃথিবী থেকেই; বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-ফিলিপিন্স-শ্রী লংকা ও আফ্রিকা মহাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষই মুলত দুবাইয়ে বসবাস করছে। এবং শুনলে অবাক হবেন যে দুবাই এ লোকল মানুষ বা আমিরাতের নাগরিকের সংখ্যা মাত্র ২০% এবং ৮০% লোকই বিভিন্ন দেশ থেকে রেসিডেন্সী কিনে দুবাইয়ে বসবাস করছে, চাকুরী করছে, ব্যবসা করছে বা যা খুশী তাই করছে। বিদেশীরা দুবাইয়ে গাড়ী-বাড়ী প্রপার্টি ক্রয় (আদতে ১০০ বছরের লীজ) করতে পারে। তবে, আমিরাতি পুরুষদের সন্তানরাই শুধুমাত্র জন্মসূত্রে আমিরাতের নাগরিকত্ব লাভ করে। কোন আমিরাতি মহিলা যদি কোন বিদেশী পুরুষকে বিয়ে করে এবং সন্তানের জন্ম দেয় – তবে সেই সন্তান আমিরাতী নাগরিকত্ব পাবে না।

তবে, দুবাই এ সবচে ভালো দিকটি হচ্ছে এখানকার আইন-শৃঙ্খলা খুবই কড়া। পুলিশ খুবই একটিভ। চিকিৎসা সেবা দুর্দান্ত। এবং স্থানীয় আমিরাতী লোকগুলি মারাত্বক রকমের অহংকারী। কারণ এরা বসে বসেই টাকা আয় করতে পারে; সরকার থেকে প্রচুর নাগরিক সুবিধাদি পেয়ে থাকে। এদের আচরণও অসুন্দর। যদিও এদের খুব একটা দেখা যায় না।

দুবাইয়ে রাস্তাঘাট সুন্দর। ট্রাফিক সিস্টেম ভালো। ক্রাইম নেই বললেই চলে। রাজনীতি নিষিদ্ধ। রাজতান্ত্রিক দেশ, রাজারা দেশ শাসন করে। রাজার বিরুদ্ধে কোন কথা বলার কোন সুযোগ নেই।

আশা করি এবার দুবাই সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছেন।

এবার চলুন আলোচনা করি এখানে বিদেশীরা বা যারা রেসিডেন্স ভিসায় রয়েছেন তারা কি করে?

কর্পোরেট জবগুলো করছে মুলত ভারতীয় এবং ফিলিপিনোরা।

বড় কর্পোরেট হাউজগুলোর মালিকানায় রয়েছে আরাবিয়ানদের সংগে যৌথভাবে ইওরোপিয়ানরা। কর্পোরেট জবগুলো উচ্চ পদগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বৃটিশ ও ইওরোপিয়ানরা যাদের বেতন অনেক অনেক বেশী; বছরে মিলিয়ন ডলারেরও উপরে। নিম্ম পদগুলোতে রয়েছে ভারতীয়রা। ভারতীয়দের সুবিধা হচ্ছে তারা খুব ভালো ইংলিশ জানে।

ট্যাক্সিক্যাব চালাচ্ছে পাকিস্তানীরা। আমার ধারণা শতকরা ৮০ ভাগ ট্যাক্সি ড্রাইভার পাকিস্তানী। ১০ ভাগ ভারতীয় এবং বাকীরা আফ্রিকান ও বাংলাদেশী। অল্প কিছু পাকিস্তানীও কর্পোরেট জব করছে।

বাঙালীর সবচে বড় সমস্যা হচ্ছে এরা মোটেও দূরদর্শী নয় এবং ইংলিশ জানে না। এদের ভরসা হিন্দী বা উর্দূ। হিন্দু উর্দূ দিয়ে আহামরী কিছু করা সম্ভব নয়, রেস্টুরেন্টের ওয়ার্কার বা মুদী দোকানের কর্মচারী হওয়া ছাড়া। এছাড়া ক্লিনিং জবেও বাঙালী দেখা মিলে। আর এসব জবে বেতন খুবই কম। যে পরিমানে বাঙালী সেখানে রয়েছে সে পরিমানে সস্তা জব সেখানে নেই। কাজেই বাঙালীদের বেশীরভাগকে দেখা যায় তারা হিন্দী-উদূ দিয়ে সস্তা চাকুরী খুঁজতেই ব্যস্ত। ভালো চাকুরীর ধারে কাছেও এরা ঘেঁষতে পারে না।

যোগ্যতাবলে ভালো চাকুরীগুলো ভারতীয়-ফিলিপিনো এবং কিছু পাকিস্তানী তা বাগিয়ে নেয়।

আপনি যদি কোন হাতের কাজ না জানেন তাহলে আপনাকেও ওখানে গিয়ে দোকান বা রেস্টুরেন্ট কর্মচারী অথবা ক্লিনারের সস্তা বেতনের চাকুরী করতে হবে। তিন বা সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ করে দুবাই গিয়ে হাজার বারশত দেরহাম বেতনে সস্তা চাকুরী করে আপনার কি পোষাবে? তারউপর বাসা ভাড়াও বেশী। মেস করে যারা থাকে – এক রুমের ভেতরে ১৫-২০ থাকে; ১ টা মাত্র বাথরুম ব্যবহার করে; মাসিক ভাড়া ৩০০ দেরহাম। খাওয়া খরচও আরোও ৩০০ দেরহাম। চলবে?

আপনি যদি দুবাই গিয়ে ড্রাইভিং করেন বা ট্যাক্সি চালান তাহলে ৩ থেকে ৪ হাজার দেরহাম বা ১ লাখ – সোয়া লাখ বাংলা টাকা অনায়াসেই আয় করতে পারবেন। প্লাম্বারের জবও রয়েছে, রয়েছে কন্সট্রাকশন কাজেরও সুযোগ।

কিছু লোক রয়েছে কাজ ধরিয়ে দেবার দালালী করে; এরা ২ হাজার দেরহাম এর বিনিময়ে একটা চাকুরীতে ঢুকিয়ে দেয়।

আপনার হাতে যদি লাখ পচিশেক বাংলা টাকা থাকে, তাহলে আপনি প্রতি সপ্তাহে ২ বার করে দুবাই আসা যাওয়া করতে পারেন। আসার সময় ২টি গোল্ডের বিস্কুট এবং বাড়তি ১০০ গ্রাম গোল্ড নিয়ে আসতে পারবেন। সংগে আনবেন ১টি ল্যাপটপ ও ২টি ব্যবহৃত আইফোন। এতে মাসে ৭/৮ বার আসা যাওয়া করতে পারলে বিমান ভাড়া, স্বর্ণের ট্যাক্স দেবার পরও ২-আড়াই লাখ টাকা নেট প্রফিট করতে পারবেন। এই ব্যবসাটা অনেকেই করছে; প্রচুর লোক করছে। প্রতিদিন যে অনেকগুলো ফ্লাইট ঢাকা-দুবাই-ঢাকা আসা যাওয়া করে তাদের অধিকাংশই নাকি এই ব্যবসায় জড়িত।

আপনি দুবাই গিয়ে কি করবেন?

যাবার আগেই ভেবে ঠিক করে নেয়াটা অধিক যুক্তিযুক্ত।

তবে, একটা গ্রুপের কিছু মানুষের কর্মকান্ড আমার পছন্দ হয়েছে।

আপনি রেসিডেন্সী নিয়ে দুবাই গেলেন। তারপর নিজেকে কোম্পানীর একটি ভালো পদে চাকুরীরত দেখিয়ে একটি ব্যাংক একাউন্ট করলেন। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভালো এমাউন্টের কিছু টাকা স্যালারী হিসাবে একাউন্টে জমা করালেন। তারপর সেই স্যালারী থেকে হালকা খরচ করে করে মাস শেষে কিছু ব্যালেন্স রাখলেন। ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নিলেন। তারপর ৫/৬ মাস পর যখন নিয়মিত করলেন – এতে আপনার একটা সুন্দর কর্পোরেট প্রফাইল দাঁড়িয়ে গেলো; একাউন্টে ২৫-৩০ হাজার দেরহাম ব্যালেন্স থাকলে তো কথাই নেই। এবার এসব ডকিউমেন্টসগুলো নিয়ে বৃটিশ এম্বাসীতে ভিজিট ভিসার জন্য আবেদন করেন – চোখ বন্ধ করে বৃটিশ ভিসা পেয়ে যাবেন। শুধুমাত্র বৃটিশ ভিসা কেন – এথেকে আপনি খুব সহজেই ইওরোপীয় অনেক দেশে এবং অস্ট্রেলিয়ার ভিসাও পেয়ে যেতে পারেন।

এই বুদ্ধিতে ভিসা নিয়ে ইওরোপ যাবার বাঙালীর সংখ্যাও দুবাইতে নেহায়েত কম নয়। আর কয়েকবার ইওরোপ বা লন্ডন ঘুরে এসে আমেরিকার ভিজিট ভিসার জন্য ট্রাই করলেই বা ক্ষতি কি? আমেরিকা ভিসা দেবার জন্য কোন কাগজ-পত্র দেখে না; শুধুমাত্র মুখের কথাতেই তারা ভিসা দেয়।

করবেন নাকি চেস্টা?

এনিওয়ে অনেকেই খরচের ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন।

আমি এক্সপার্টের সংগে কথা বলেছি; কোন কোম্পানীর আন্ডারে ২ বছরের রেসিডেন্সী ভিসা নিয়ে, ম্যানপাওয়ার এবং টিকেট খরচ মিলিয়ে দুবাই পর্যন্ত সর্বমোট খরচ হয় বাংলা টাকায় ৩ লাখ টাকার সামান্য বেশী। ২ বছর পরপর রেসিডেন্সী রিনিও করতে হয় তাতেও আরও প্রায় ৬ হাজার+ দেরহাম খরচ লেগে যায়।

আমাকে যারা ইনবক্স করেছে – আশা করছি এত্থেকে আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। তাদের নিকট আমার অনুরোধ লেখাটি কম করে হলেও ৩ বার পরবেন। তারপরও যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলেই আমাকে ইনবক্সে নক করতে পারবেন।

শেষে একটা সাবধানতা। এরই মধ্যে কিছু ধুর্ত টাওট-বাটপার যারা নিজেদের আদম-ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচয় দিয়ে ইওরোপ আমেরিকায় পাঠাবো বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ৮/১০ লাখ টাকা নিয়ে বলে যে দুবাই থেকে ২/৩ দিনের মধ্যেই সরাসরি ইওরোপে ফ্লাইট হবে! এমন প্রতারণার ফাঁদে কেউ পরবেন না। এমনটা কখনওই সম্ভব নয়।

ধন্যবাদ।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *